বলের বদলে গ্রেনেড (৫ম পর্ব)

আগের পর্বগুলোঃ

৯।

জ্বর এবং চাচার কঠোর নিষেধাজ্ঞার কারণে পরবর্তী কয়েকদিন অনিকের ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। অবশ্য, কিছুটা দেরি হলেও খুলনা এবং দেশের প্রায় এলাকার খবর ঠিকই জানতে পারছিল। কেননা, রেডিও বা পত্রিকা তো ছিলই, এর পাশাপাশি ওর বন্ধুদের মধ্যে প্রায় প্রতি বেলাতেই কেউ না কেউ আসত। চাচাও অফিস থেকে ফিরে সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতেন।

চাচার কাছ থেকে জানতে পারল অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৪ মার্চ কিছু মানুষ দৌলতপুরের কাছে রেললাইন উপড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল। এ সময় পুলিশ গুলি চালালে মোট ৪ জন নিহত হয়। পুলিশ এবং আর্মি যেভাবে হার্ডলাইনে চলে গেছে, বোঝা যাচ্ছে সরকার দমননীতি বেছে নিয়েছে। এদিকে আন্দোলনও প্রতিদিনই জোরদার হচ্ছে। ফলে আগামী দিনগুলিতে সংঘাত কমার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

অবশ্য খুলনার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সবাই যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। ৫ মার্চ জেলা প্রশাসক মোঃ নুরুল ইসলাম, পুলিশ সুপার আব্দুর রকিব খন্দকার এবং খুলনা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী কমান্ডার লেঃ কর্নেল সামস-উল-সাম্‌স জেলার আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আলোচনায় বসলেন। আলোচনার শুরুতেই কর্নেল সামস গত দুইদিনের কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চান। তবে, আওয়ামী লীগের নেতাগণ তা আমলে না এনে রাস্তা থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের দাবী জানান। বিশেষ করে শেখে আব্দুল আজীজ সাফ জানিয়ে দিলেন সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা না হলে এর পরিণাম ভাল হবে না।

ঠিক এ সময়ে ওয়াকিটকিতে খবর আসে যে যশোর থেকে খুলনায় আসতে থাকা সেনাবাহিনীর একটি কনভয়ে জনতা আক্রমণ করেছে এবং সেনাবাহিনী পালটা গুলি ছুঁড়ে কয়েকজনকে হত্যা করেছে। খবর শুনে কর্নেল সামস দ্রুত আলোচনা থেকে উঠে চলে যান। এই ফাঁকে জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার দুজনেই আওয়ামী লীগ নেতাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এটা জেনে আওয়ামী লীগ নেতাদের মনোবল আরও অনেক বেড়ে যায়।

খুলনা শহরে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র কেনা-বেচার দোকান ছিল। দোকানগুলোর বেশিরভাগেরই মালিক ছিল অবাঙালি। জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপারের সাথে আলোচনার পর ঐ দিন রাতে শেখ কামরুজ্জামান টুকু তার অনুগত সহচরদের নিয়ে অবাঙালি মালিকানাধীন দোকানগুলো লুট করার সিদ্ধান্ত নেন।

অনিক ঘটনাটি জানতে পারে পরদিন সকাল বেলায়। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে পেপার পড়ছিল ও। এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে শারেক এবং কাইয়ুম ওর বাসায় আসল। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বলল,
-তোকে একটা জিনিস দেখাবো, কাউকে বলতি পারবি না।
-এত ভণিতা না করে কি দেখাবি বল!

এটা শুনে কাইয়ুম শার্ট উঁচু করে কোমরে গুঁজে রাখা একটি রিভলভার বের করল।

রিভলভার দেখে অনিক প্রথমে চমকে উঠল! চট করে জানালার পর্দা ঠিক মত ছড়িয়ে দিয়ে যখন মুখ খুলল ওর কথা কিছুটা জড়িয়ে গেল,
-এ এ এ…এটা কি পি…পি…পিস্তল??
-নারে ব্যাটা, এটা রিভলভার! ওয়েস্টার্ন নায়কের মত কয়েকবার কোমরের কাছ থেকে ড্র করার ভঙ্গি করে জবাব দিল ও। এগুলোকে বলে ব্রিটিশ রিভলভার। একবারে টানা ছ’টা গুলি করা যায়।
-তুই পেলি কোথা থেকে?
-গতকাল রাতে টুকু ভাই এর সাথে আমরা কয়েকটা দোকান লুট করেছি। প্রচুর অস্ত্র, গোলা-বারুদ এখন আমাদের দখলে এসেছে। গর্বের সাথে বলল ও।
-তুই এভাবে নিয়ে ঘুরছিস? পুলিশ দেখলে তো সাথে সাথে মেরে ফেলবে!
-আরে দূর! আমার কাছে অস্ত্র আছে এটা পুলিশ চিন্তাও করবে না। তাছাড়া এটা নিয়ে তো আমি সবসময় বের হব না। এখন শুধু তোকে দেখাতে নিয়ে এসেছি। হাতে নিয়ে দেখবি?
-আমার ভয় করছে! যদি গুলি বের হয়ে যায়?
-আরে গাধা, এতে গুলি ভরা নেই। আমি তোর মত বেকুবের হাতে গুলি ভরা রিভলভার দেব নাকি?
-এমন ভাব করছিস তুই যেন কত বছর ধরে এসব নিয়ে ঘুরিস! ভেংচি কেটে অনিক বলল।

এরপর কাইয়ুমের হাত থেকে ও রিভলভারটা নিজের হাতে নিলো। দেখে যেরকম আন্দাজ করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ভারি। অবশ্য কিছুক্ষণ ধরে থাকলে ওজনটা হাতের সাথে বেশ মানিয়ে যায়! প্রথমে ভয়ে ভয়ে ধরলেও ধীরে ধীরে বেশ মজা পেয়ে গেল অনিক। মুখ দিয়ে শব্দ করে কয়েক রাউন্ড কাল্পনিক গুলিও করল!
-হয়েছে! এটা তোর খেলার জিনিস না। এবার ওটা রেখে দে…
-যাই বলিস, এরকম একটি জিনিস হাতে আসলে সাহসই বেড়ে যায়।
-ঠিক বলেছিস, আমি আর শারেক যখন তোদের বাসায় আসছিলাম নিজেকে অজেয় মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কোন পুলিশ, আর্মি আমার কিছু করতে পারবে না।
-কিন্তু, তোর কাছে তো গুলি নেই।
-আছে তো! রিভলভারে ভরা নেই, কিন্তু পকেটে ছয়টা গুলি আছে। বলে পকেট থেকে গুলি বের করে দেখাল কাইয়ুম। বাসায় আরও পঞ্চাশ রাউন্ড মত আছে।
-বলিস কিরে! কাল তো মনে হয় তোরা দোকান একেবারে সাফ করে ফেলেছিস!
-তো আর বলছি কি! পাকি পুলিশ, আর্মিদের সাথে কয়েকদিন ফাইট দেবার মতন আগ্নেয়াস্ত্র এখন আমাদের কাছে আছে।

এমন সময় চাচীর ডাক শুনে ওরা দ্রুত সবকিছু লুকিয়ে ফেলল। অনিক উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। চাচী ওদেরকে দেখে বললেন,
-তোরা দরজা বন্ধ করে কি করছিস?
-কিছু না চাচী, খুলনার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা করছিলাম…আর কি!
-দরজা বন্ধ করে কোন আলোচনা করা চলবে না। তোর চাচা নিষেধ করেছে। বলেছে তোর উপর চোখ রাখতে।
-আমি তো ঘর থেকেই বের হতে পারছি না…! মুখ কালো করে বলল অনিক।
-তোর কিছু হলে ভাইজান-ভাবীকে আমরা মুখ দেখাবো কেমন করে? তাছাড়া তুই এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠিস নি…
-তা তো বুঝি, কিন্তু…
-আর কোন কিন্তু না। শারেক, কাইয়ুম… তোরা এখন বাসায় যা।
-আচ্ছা, চাচী।

অনিক ওদেরকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেল। চাচীকে না দেখে কাইয়ুম ফিসফিস বলল,
-আগামী ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন। রেডিও, টিভিতে নাকি সরাসরি শোনাবে। এক কাজ করি চল, সবাই মিলে এক সাথে কোথাও বসে ভাষণ শুনি…
-এটা অবশ্য করা যায়। অনিক বলে উঠল। দুইদিনের মধ্যে আমি নিশ্চয়ই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাব।
-আমার বাবা বলেছেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন। শারেক জানালো। তবে, পাকিস্তান সরকার শুনলাম কড়া নজরে রাখবে। উলটা-পালটা কিছু দেখলে কঠোরভাবে দমন করবে।
-দমন করবে, হুহ! এত সোজা! কাইয়ুম কঠিন স্বরে বলে উঠল।
-আচ্ছা, তোরা এখন যা, ভাষণ একসাথে কোথায় শুনতে চাস-আমাকে জানিয়ে দিস। আমি চলে আসব।
-ঠিক আছে!

————–

৭ মার্চ সকাল থেকেই খুলনার সবাই একই সাথে দারুণ উত্তেজনা এবং উৎকণ্ঠায় ভুগতে শুরু করল। উত্তেজনা এই জন্য যে বঙ্গবন্ধু আজকের সমাবেশেই চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতে পারেন, আর উৎকণ্ঠা এই ভেবে ইয়াহিয়া সরকার এর বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে কে জানে!

দুপুর হতেই সবাই রেডিও বা টেলিভিশনের সামনে বসে গেল। সকালে কাইয়ুম বলে গেছে সবাই মিলে ক্লাব ঘরে বসে রেডিওতে এই ভাষণ শোনার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনিক ঘর থেকে বের হতে পারল না। চাচা কঠোর ভাষায় বলে দিয়েছেন ঘর থেকে বের না হবার জন্য। চাচীকে বলেছেন প্রয়োজনে ওর ঘরে তালা মেরে রাখতে। নিষেধাজ্ঞার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, সরকার যে কোন পরিস্থিতির জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলেছে। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের চারপাশে নাকি প্রচুর পদাতিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে সবগুলো এফ-৮৬ যুদ্ধ বিমানগুলোকে নাকি প্রস্তুত করে রাখা হবে। বঙ্গবন্ধু উল্টা-পাল্টা কিছু করতে চাইলে যাতে সহজে দমন করা যায়, এজন্য সরকারের এই প্রস্তুতি। ফলে, আজকে ঘর থেকে বের হওয়া কোন মতেই ঠিক হবে না।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেল, ধীরে ধীরে সন্ধ্যাও হল…কিন্তু, রেডিও কিংবা টেলিভিশনে কিছু শোনা গেল না। কিছুক্ষণ পর কোথা থেকে যেন খবর আসল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ হয়ে গেছে! সরকার প্রথমে সরাসরি সম্প্রচারের অঙ্গীকার করলেও পরে মত বদলে তা বন্ধ করে রেখেছিল।

রাতের বেলা চাচা এসে জানালেন বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে কিছু না বললেও বলার কিছু বাকি রাখেন নি। পশ্চিম পাকিস্তানীদের অন্যায় অত্যাচার, গত কিছুদিনের নির্মমভাবে মানুষ হত্যা, ক্ষমতা হস্তান্তরের টালা বাহানা সহ সব কিছু নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি আমাদের সবাইকে প্রস্তুত হতে বলেছেন, তাঁর কথার ইঙ্গিতে বোঝা গেছে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু নাকি স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা বলে ভাষণ শেষ করেছেন!

-চাচা, ভাষণটা কি আমরা শুনতে পারব না? অনিক জিজ্ঞাসা করল।
-সরকার ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করতে দেয় নি বলে রেডিও-টেলিভিশনের সকল বাঙ্গালি কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। বেকায়দায় পড়ে কর্তৃপক্ষ আগামী কাল সকাল সাড়ে আটটায় ভাষণের পূর্ণ বিবরণ প্রচার করার অঙ্গীকার করেছে। এর মানে হচ্ছে কালকে সকালে পুরোটা শুনতে পারবি।
-উফ! আমার আর তর সইছে না, চাচা!
মুচকি হেসে চাচা রাতের খাবার খাওয়া শুরু করলেন।

পরদিন ঠিক সাড়ে আটটায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এক সাথে রেডিও-এবং টেলিভিশনে পুনঃপ্রচারিত হল। চাচা জানালেন সমাবেশে নাকি দশ লাখেরও বেশি মানুষ জমায়েত হয়েছিল! প্রায় উনিশ মিনিটের এই ভাষণ শোনার সময় আক্ষরিক অর্থেই সবার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল এবং সবাই যেন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে শুরু করল।

বঙ্গবন্ধু শুরু করলেন খুব ঠাণ্ডা মাথায়-‘ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি…’ এরপর একে একে ইয়াহিয়া সরকারের অন্যায়-অনাচারের কথা তুলে ধরা শুরু করলেন। প্রথমেই গত এক সপ্তাহ ধরে বাঙালি হত্যা-নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে যার কাছে যা আছে সেসব নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য আহবান জানালেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আলোচনায় বসার প্রস্তাবের জবাবে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সৈন্যদের ব্যারাকে ফেরত নেয়া, হত্যা-নির্যাতনের তদন্ত এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের শর্ত জানিয়ে দেন। একই সাথে হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার আহবান জানিয়ে পরবর্তী কর্মসূচিও জানিয়ে দেন। পাশাপাশি এ কথাও বলেন যে ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা (সব কাজ) বন্ধ করে দেবে’! সুতরাং সামরিক সরকার তাঁকে গ্রেফতার বা হত্যা করে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করে দিতে পারে- এমন আশংকার কথাও প্রকাশ পায়।

সেক্ষেত্রে তিনি তাঁর অনুপস্থিতিতে সংগ্রাম চালিয়ে নেবার বিকল্প পথের নির্দেশনাও দিলেন অর্থাৎ সবাই যেন নিজ নিজ উদ্যোগেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। সবাইকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার আহবান জানালেন। কোন সন্দেহ নেই যে এই কথার মধ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের ইংগিত রয়েছে! সবশেষে সত্যি সত্যিই তিনি স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’!

ভাষণ প্রচারিত হবার ঘণ্টা-খানেকের মধ্যেই রাস্তায় মিছিলের আওয়াজ শোনা গেল। অনিক বুঝতে পারল ওদের মত আশপাশের সবাই ভাষণ শুনেছে। এরকম উজ্জীবিত ভাষণের পর আন্দোলন যে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠবে- তাতে ওর মনে কোন সন্দেহ নেই!

১০।

৭ ই মার্চের ভাষণের পর সারা বাংলাদেশের মতন খুলনা নগরীও কার্যত অচল হয়ে পড়ল। অফিস-আদালত, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা-গুলোয় উপস্থিতির হার শূন্যের কাছাকাছি চলে গেল। মাওলানা ভাসানীসহ যেসব রাজনৈতিক নেতাসমূহ একসময় শেখ মুজিবের জেনারেল ইলেকশনে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন, তারাও চলমান অসহযোগ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করলেন। এদিকে জনসাধারণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিল। ফলে সত্যিকার অর্থে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন শেখ মুজিবের নির্দেশ মতই চলতে শুরু করল।

ভাষণের পরপরই প্রতিটি জেলা, মহকুমায় গঠন করা হল স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এতে করে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও আগের চেয়ে অনেক বেশি জোরদার হয়ে উঠল। পাশাপাশি অর্থ, খাবার এবং প্রশিক্ষণার্থী সংগ্রহের কাজ আগের চেয়ে সহজ হল। সমাজের প্রায় সকল স্তরের মানুষও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া শুরু করল।

যোগাযোগ ব্যবস্থা মারাত্মক ব্যাহত হবার কারণে খাদ্যসহ সকল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সংকট শুরু হল। এমনকি সেনানিবাসগুলোতেও এর প্রভাব পড়া শুরু হল। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার বিভিন্ন সামরিক বিধি জারি করে এবং বিভিন্ন সংস্থাকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না। শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া সরকার শেখ মুজিবের সাথে পুনরায় আলোচনার ব্যাপারে কথা বলা শুরু করে, অবশ্য একই সাথে ১৩ মার্চ এক সামরিক বিধি জারি করে যাতে বলা হল প্রতিরক্ষা খাত থেকে বেতন-ভাতা গ্রহণকারী সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আগামী ১৫ মার্চের মধ্যে অবশ্যই কর্মস্থলে হাজির হতে হবে। তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সাথে সরকার শেখ মুজিবের সাথে পুনরায় আলোচনারও সিদ্ধান্ত নেয়।

সরকারের এই নির্দেশের পালটা কর্মসূচী হিসেবে শেখ মুজিব ঐ দিনই নতুন ঘোষণা দেন। ঘোষণায় ১৫ মার্চ থেকে সেক্রেটারিয়েট, সকল সরকারি এবং আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে লাগাতার ধর্মঘটসহ ৩৫ টি নির্দেশের কথা উল্লেখ ছিল। অবশ্য, একই সাথে সরকারের সাথে পুনরায় আলোচনার ব্যাপারেও তিনি সম্মতি জ্ঞাপন করেন।

শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার উদ্দেশ্যে ১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসলেন এবং ১৬ মার্চ থেকে আলোচনা শুরু হল। জানা গেল খুব শীঘ্রই ভূট্টোও ঢাকা আসবেন এবং আলোচনায় অংশ নেবেন। বলা হল সবাই মিলে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করবেন, অথচ আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক সৈন্য এবং অস্ত্র-গোলাবারুদ আসতে লাগল।

এ সময় একই সাথে একের পর এক আলোচনা এবং কঠোর আন্দোলন চলতে থাকল। প্রায়শই দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটতে থাকল অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষ। চলতে থাকল হতাহত হবার ঘটনা। আলোচনা, আন্দোলন, সামরিক বাহিনীর তৎপরতার মাঝে সাধারণ জনগণ উদ্বেগ, আশংকা এবং উত্তেজনার মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে থাকল। এ সময় নানা রকম গুজব এবং সন্দেহের কথাও ছড়াতে লাগল।

১৭ মার্চ বিকালে অনিক বাসার বারান্দায় চেয়ারে বসে খুলনার স্থানীয় পত্রিকা সাপ্তাহিক পূর্বাঞ্চল পড়ছিল। এমন সময় দীপ্তদা এলো। ওকে দেখে হাসি দিয়ে বললেন,
-কিরে, তুই নাকি গৃহবন্দী হয়ে রয়েছিস?
-সেরকম কিছু না…মাত্র জ্বর থেকে উঠলাম তো, চাচা ঘর থেকে আপাতত বের হতে নিষেধ করেছেন। তাছাড়া দেশের যে অবস্থা…
-আমরা কি দেশের বাইরে থাকি নাকি? দিব্যি তো ঘুরে বেড়াচ্ছি…
-তোমাদের কথা আলাদা, বাপ-মা’র সাথে থাকলে আমিও হয়ত এভাবে বসে থাকতাম না!
-তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা, শোন সেদিনের সার্কিট হাউজের গার্ডদের ব্যাপারে কি বলেছিলাম মনে আছে?
-কোন গার্ডের কথা বলছ?
-ঐ যে ব্যাঙ আর মোচুয়া…আমাদের সাথে খুব চোট-পাট করল…
-ওহ, হ্যাঁ! মনে পড়েছে! কি জানি বলেছিলে??
-ধুর! তুই ভুলেই গেছিস। যা হোক, ঐ যে বলেছিলাম ‘শালাদের বোম মেরে যদি উড়িয়ে না দিয়েছি…!’ গলা খাদে নামিয়ে দীপ্ত বলল।

এবার সত্যিই অনিকের সেইদিনের কথা মনে পড়ল।
-হ্যাঁ, এবার আসলেই মনে পড়েছে। তো? কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে বলল ও।
-না তেমন কিছু না…খালি বলব আজকে কষ্ট করে রাত একটা পর্যন্ত জেগে থাকিস। সে সময় যদি কোন বিকট আওয়াজ শুনতে পাস- তাহলে বুঝবি ‘ব্যাঙ’ মারা উৎসব হচ্ছে! বলে চোখ টিপ দিলেন!
-বল কি?? অনিকের চোখ বড় বড় হয়ে গেল!
-সসসসশশ… তোর বাসা সার্কিট হাউজের সবচেয়ে কাছে বলে জানালাম। খবরদার, আর কেউ যেন কিচ্ছু জানতে না পারে। ঠিক আছে?
-ঠিক আছে, দীপ্তদা! তবে, তুমি কিন্তু খুব সাবধানে থাকবে। প্লিজ! অনিক অনুনয় করল।
-চিন্তা করিস না। আমাদের সাথে এক্সপার্ট থাকবে। তাছাড়া আমিও দূরে থাকব-অবজারভার বলতে পারিস! আচ্ছা, এখন আমি যাই। পরে কথা হবে।

সন্ধ্যে হবার পর থেকেই অনিকের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া শুরু হল। অবস্থা এমন হয়ে উঠল যে রাতের বেলা খাওয়ার সময় ওর অস্থিরতা পরিষ্কার বোঝা গেল। খাওয়ার টেবিলে ওকে দেখে প্রথমে কিছু না বললেও শেষ পর্যন্ত চাচা জিজ্ঞাসা করলেন,
-কিরে তোর কি হয়েছে? আবার জ্বর আসছে নাকি?
-নাহ। পড়ার একটা নতুন রুটিন তৈরি করেছি তো…তাই বারবার ঘড়ি দেখছিলাম।

চাচা ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এরপর বললেন,
-আগে খাওয়া শেষ কর, পরে রুটিন নিয়ে চিন্তা করিস।
-ঠিক আছে, চাচা।

কোন মতে খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেল অনিক। মাত্র ১০ টা ২২ বাজে। ১ টা বাজবার এখনো অনেক দেরি। অথচ মনে হচ্ছে যে কোন সময় শব্দ হতে পারে। প্রতিটি মুহূর্ত ওর নার্ভের উপর প্রচণ্ড চাপ পড়তে শুরু করল। মন অন্য কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য গল্পের বই পড়া শুরু করল।

বই পড়তে পড়তে কোন সময়ে চোখে লেগে গেছে জানতেও পারল না। ঠিক ১ টা ৫ মিনিটে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ শোনা গেল। কয়েক সেকেন্ড পর টানা আরও কয়েকটি শব্দ। এরপর ‘জয় বাংলা’ স্লোগান শুনতে পেল! ততক্ষণে চাচা দৌড়ে ওর ঘরে চলে এসেছেন। অনিককে রুমে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
-সম্ভবত সার্কিট হাউজে কেউ বোমা মারল। চাচা বললেন।
-শব্দ শুনে সেরকমই তো মনে হচ্ছে!
-নির্ঘাত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কাজ! সার্কিট হাউজের গার্ডদের উপর সেদিনের মিছিলে গুলি করার বদলা নেবার জন্য এরকম করল!
-হুম।
-তুই লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়। এখন আর পড়াশুনার দরকার নেই।

চাচাকে বিদায় জানিয়ে দ্রুত লাইট বন্ধ করে অনিক ভাল করে শুয়ে পড়ল। মনে মনে দীপ্তদার জন্য দুশ্চিন্তা হতে লাগল।

দীপ্তদা নিরাপদে ফিরতে পেরেছেন তো?

সকালে উঠেই অনিক সার্কিট হাউজে বোমার মারার পূর্নাঙ্গ বিবরণ শুনতে পেল। চাচা পুলিশ লাইন থেকে শেষ খবর জেনে এসেছেন। রাতের বেলা ‘কে বা কারা’ সার্কিট হাউজের পশ্চিম প্রান্ত থেকে একসাথে বেশ কয়েকটি শক্তিশালী বোমা নিক্ষেপ করেছিল। কেউ মারা না গেলেও তিনজন গার্ড মারাত্মক আহত হয়েছে। এরমধ্যে একজনের অবস্থা বেশ খারাপ। তিনজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুরো শহর জুড়ে পুলিশ, আর্মি টহল দিচ্ছে। প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ঘর থেকে বের না হবার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সাথে জানালেন আক্রমণকারীরা এখনো কেউ ধরা পড়ে নি, তবে জোর তদন্ত চলছে!
শেষের অংশটুকু শুনে ওর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা চাচার দৃষ্টি এড়াল না। অবশ্য এটা নিয়ে তিনি কোন কথা বললেন না।

দুপুরে ওরা সবাই একসাথে খেতে বসল। চাচা বললেন,
-অনিক তোর চাচীর সাথে আলোচনা করে আমরা ঠিক করেছি তোকে গোপালগঞ্জে পাঠিয়ে দেব। এখানে থাকাটা তোর জন্য আর নিরাপদ হবে না। সামনে কি পরিস্থিতি হয় কে জানে, তুই বরং আপাতত তোর বাবা-মা’র কাছেই চলে যা। আমি ইতোমধ্যে স্টিমারে তোর টিকিট করে ফেলেছি। আমার কয়েকজন সহকর্মী তাদের পরিবারকে গোপালগঞ্জে রেখে আসার জন্য আগামী কাল একই স্টিমারে যাবে। তোর কোন সমস্যা হবে না।
-কিন্তু চাচা…
-নাহ, কোন কিন্তু না। তোর বয়সী ছেলেদের প্রত্যেককেই সরকার এখন সন্দেহের চোখে দেখছে। আমি আর কতক্ষণ তোকে চোখে চোখে রাখব? এরচেয়ে তুই বরং বাড়ি চলেই ভাল হবে। আমার চিন্তা কমবে, তার বাবা-মা’কেও আর অহেতুক দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে না।

এরপর তো আর বলার কিছু থাকে না! অনিক চুপচাপ খাবার খেতে লাগল।

বিকালে কিছুক্ষণের জন্য ক্লাবে গিয়ে সুনীলদার সাথে দেখা করতে চাইল। কিন্তু গিয়ে দেখল দরজায় তালা মারা। সাথে কাগজ কলম ছিল, ছোট্ট করে একটি নোট লিখে দরজার নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। মনে হল সুনীলদার সাথে দেখা না হয়েই ভাল হয়েছে, বিদায় ব্যাপারটি ওর কখনোই ভাল লাগে না। অবশ্য একই সঙ্গে একটু খারাপও লাগছে, আবার কবে দেখা হবে কে জানে?

পথে শাহিন ভাই এর সাথে দেখা হয়ে গেল। শাহিন ভাই ওকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানালেন এবং বললেন সবাইকে জানিয়ে দেবেন। ‘যাক, অন্তত একজনের সাথে হলেও তো দেখা হল!’-মনে মনে ভাবল অনিক। তবে, কাইয়ুম, শারেক, সুমনের সাথে দেখা না হওয়ায় মনটা ভার হয়ে রইল।

পরদিন ভোর বেলা অনিককে নিয়ে চাচা বাসা থেকে বের হলেন। বই-খাতা, ব্যাট-বল, কাপড় ইত্যাদি নেবার কারণে ব্যাগের আকৃতি বেশ বড় হয়ে গেছে! এ সময় চাচী কান্নাকাটি করে বিদায়টা ওর জন্য কিছুটা কষ্টদায়ক করে তুললেন। যাই হোক, চাচা ওকে স্টিমারে তাঁর সহকর্মীদের সাথে উঠিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টিমারের ইঞ্জিন চালু হয়ে চলা শুরু করল। ধীরে ধীরে স্টিমারের গতি বাড়তে লাগল। হঠাৎ দূরে অনিক দেখতে পেল কাইয়ুম ঘাটের দিকে দৌড়ে আসছে। নিশ্চয়ই শাহিন ভাই কিংবা সুনীলদার কাছ থেকে খবর পেয়েছে, তাই সকালে উঠেই জাহাজ ঘাটে চলে এসেছে! হাতের ইশারায় চিঠি লেখার কথা বুঝিয়ে দিল ও! দুজনে দুজনকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালো!

ধীরে ধীরে চাচা এবং কাইয়ুমের অবয়ব ছোট হতে হতে একসময় দিগন্তে হারিয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নদীর দুই পাড়ের দৃশ্য দেখায় মনোযোগ দিল অনিক।

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।