আমার দেখা স্বর্গপুরি – ১

ফার্স্ট টার্ম এন্ডের ছুটি শেষ হতে মাত্র ৮ দিন বাকী। এর মাঝে হঠাৎ করেই মাথায় ইউরোপ ট্যুরের ভূত চেপে বসলো। ভেবেছিলাম ভিসা পেতে অনেক ঝামেলা হবে কিন্তু তেমন কোন ঝামেলা হলো না। দুই মাসের স্যাঞ্জন ভিসা নিয়ে ফ্রান্স এম্বাসি থেকে সোজা রওনা হলাম ভিক্টোরিয়া বাস স্টেশনের দিকে। অনেকগুলো প্যাকেজ অপশনের মধ্য থেকে আমি আর তৌহিদ “লন্ডন-আমস্টারডাম-প্যারিস-লন্ডন” রুটের দুইটি ওপেন টিকিট কাটলাম। ঐদিনই রাত দশটায় ইউরো লাইনস এর বাসে উঠে পড়লাম। দেরী করে যাওয়ার কারনে আমাদের বসতে হল একেবারে পেছনে। একসময় বাসের পেছনে বসার জন্য মারামারি পর্যন্ত করেছি কিন্তু আট ঘন্টার দীর্ঘ যাত্রায় এটা মোটেও সুখকর নয়। অনেকটা বিরক্তি নিয়েই শুরু হল আমাদের প্রথম ইউরো ট্যুর। বাসের মধ্যেই পরিচয় হল সহযাত্রী ব্রাজিলিয়ান মেয়ে ক্যাথিয়া অলিভেইরা এবং ব্রিটিশ বন্ধু পলের সাথে। এদের দুজনেরই গন্তব্য আমস্টারডাম। একজন ট্যুর শেষ করে আমস্টারডাম থেকে রিটার্ন ফ্লাইটে ব্রাজিল চলে যাবে আর অন্যজন শখের ভ্রমনে বেরিয়েছেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই তুমুল আড্ডা জমে উঠলো আর সাথে সাথে যাত্রা শুরুর বিরক্তিটা একেবারেই বিলীন হয়ে গেল। যাত্রার প্রথম স্টপেজ ইংলিশ চ্যানেলের ডোভার বন্দরে। সবাই বাস থেকে নেমে ইমিগ্রেশন ফরমালিটি শেষ করে ১০ তলা ফেরির ছাদে গিয়ে উঠলাম। রাতের বেলায় অপরুপ ডোভারের প্রকৃত সৌন্দর্য্যটা ঠিক মত দেখতে পারিনি। এই প্রথম মনে হলো দিনের বেলায় যাত্রা করলেই হয়তো ভাল হত। তবে ঘন্টাখানেক সময় ফেরিতে ভালই কেটেছে।

ভোর ৬ টার দিকে পৌঁছে গেলাম আমস্টারডাম। যাত্রাকালীন আড্ডায় তৈরী হওয়া বন্ধুত্বের মর্যাদা দিতেই সবাই গেলাম শ্যিফল বিমানবন্দরে আমাদের ব্রাজিলিয়ান বন্ধু ক্যাথিয়া অলিভেইরাকে বিদায় দিতে। বিমানবন্দরেই সকালের নাস্তা সেরে আমরা তিনজন শহরের এক প্রান্তে অবস্থিত একটা ইউথ হোস্টেলে উঠলাম। হোস্টেল থেকে ফ্রেশ হয়েই আমি আর তৌহিদ বেরিয়ে পড়লাম আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী। ছোট্ট ছিমছাম শহর আমস্টারডাম। মাকড়সার জালের মত ছড়িয়ে আছে পরিকল্পিত ভাবে তৈরী অসংখ্য ক্যানাল। ক্যানালের মধ্যে জমজমাট ছোট বড় বোট-হাউজ। রাস্তায় ট্রাম আর বাইসাইকেলের আধিক্য। শহরের মাঝে এলোমেলো কিছুক্ষন ঘুরাফিরা করে নিজেদেরকে ওরিয়েন্ট করে নিয়ে চলে এলাম মাদামতুস্যো জাদুঘরে। মোম দিয়ে তৈরী পৃথিবীর সব বিখ্যাত বিখ্যাত মানুষের জীবন্ত মুর্তি দেখে আমাদের বিস্ময়ের সীমা থাকল না। স্বপ্নের মানুষগুলোর সাথে ফটোসেশন করতে করেত আর পুরো জাদুঘর ঘুরে দেখতে দেখতে কেটে গেল ৩ ঘন্টারও বেশি সময়। বিকালের দিকে ভ্যানগগ মিউজিয়ামটা দেখে দিনের কার্য্যক্রম শেষ করলাম।

ম্যারিলিন মনেরার সাথে

ম্যারিলিন মনেরার সাথে

প্রিন্সেস ডায়ানা এবং...

প্রিন্সেস ডায়ানা এবং...

বিল ক্লিনটন

বিল ক্লিনটন

কে আসল আর কে নকল...??

কে আসল আর কে নকল...??

সন্ধ্যা নামতেই যেন অচেনা হয়ে গেল সারাদিনের দেখা ছোট্ট শহরটা। চারিদিক কেমন যেন মাদকতায় ভরে উঠলো। মোড়ে মোড়ে জমে উঠলো জুয়া আর নেশার খেলা। রঙ্গিন আলোর ঝিকিমিকি আর উন্মত্ত করা মিউজিকের তালে তালে পুরা শহর যেন নেচে চলেছে। বিপুল উৎসাহ নিয়ে আমরা নিজেদেরকে ভাসিয়ে দিলাম অজানা এক স্রোতে। সহসাই চোখে পড়লো জমকালো একটি বিল্ডিং যা “সেক্স মিউজিয়াম” নামে পরিচিত। এই মিউজিয়ামটির দ্বার উন্মোচন হয় রাত ১০ টার পর। মিউজিয়ামের ভেতরে কি দেখেছি সেটা না বলায় শ্রেয়। “রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট” এর কথা আগেই শুনেছিলাম। অনেক কৌতুহল নিয়ে মাঝরাতের দিকে গেলাম সেখানে। আমস্টারডামকে কেন ইউরোপের সেক্স ক্যাপিটাল বলা হয় সেটা মাঝরাতে রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট-এ না গেলে বুঝতে পারতাম না। ঘুরতে ঘুরতে অনেক রাত হয়ে গেছে, ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। একটা অ্যারাবিয়ান রেস্টুরেন্টে ঢুকে ফিলাফ্যাল এর একটা আইটেম খেলাম। ক্ষুধার কারনেই হোক অথবা অন্য যে কারনেই হোক এমন অসাধারণ খাবার আমার জীবনে আগে খেয়েছি বলে মনে পড়ল না। এই ফিলাফ্যালের স্বাদ এখনো আমার জিভে লেগে আছে। অনেক রাত করে হোস্টেলে ফিরেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

পরদিন সকাল হলো একটু দেরিতেই। আজকের দিনের পরিকল্পনা হলো উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো। হোস্টেল থেকে চেক আউট করে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। বাইসাইকেল রেন্টের একটা দোকান থেকে সারাদিনের জন্য দুইটা বাইসাইকেল ভাড়া করলাম। অনেক অনেক মজা করে আমি আর তৌহিদ শহর এবং শহরের আশে পাশের এলাকা ঘুরে বেড়ালাম। সময়ের অভাবে কান্ট্রি সাইডের টিউলিপ বাগানে যেতে পারিনি কিন্তু শহরের আশেপাশের ছোট ছোট টিউলিপ বাগান গুলো আমাদের মুগ্ধ করেছিল। দুপুরের লাঞ্চ হিসাবে আমরা সাথে নিয়ে ছিলাম ব্রেড, জেলি আর কলা। লেকের ধারে সুবিধামত স্থানে যাত্রাবিরতি করে আমরা মজাদার, সুস্বাদু ও স্বল্প বাজেটের খাবার দিয়ে পেটের পূজাটা সেরে নিলাম। ঘুরতে ঘুরতে কখন যে দিন শেষ হয়ে গেল টেরই পেলাম না। বিকালের দিকে ট্যুরিস্টদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষনীয় প্যাকেজ “রিভার ক্রুজ” অর্থাৎ নৌকা ভ্রমন করে পুরা শহরের সৌন্দর্য আর একবার উপভোগ করলাম।

বাইসাইকেল ভ্রমন

বাইসাইকেল ভ্রমন

শহরের মাঝে ছোট টিউলিপ বাগান

শহরের মাঝে ছোট টিউলিপ বাগান

মজা করে মাজাদার ও সুস্বাদু লাঞ্চ করছি আমি আর তৌহিদ

মজা করে মাজাদার ও সুস্বাদু লাঞ্চ করছি আমি আর তৌহিদ

নৌকা ভ্রমন

নৌকা ভ্রমন

রাত ১২ টায় প্যারিসের উদ্দ্যেশে বাস ছেড়ে যাবে। তাই সন্ধ্যার সময়টুকু নষ্ট না করে আবার ছুটে গেলাম শহরের প্রাণকেন্দ্রে। মন যেন কি খোঁজে!!!

(সকল বর্ণনা ২০০৪ সালের)
চলবে……………

১,৯২১ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “আমার দেখা স্বর্গপুরি – ১”

  1. নাজমুল (০২-০৮)

    🙁 সবাই খালি ঘুরতে যায় 🙁
    আমার বাসার পাসেই আজিমপুর গোরস্থান কালকে গিয়া কয়েকটা ছবি তুলে একটা ছবি ব্লগ দিব নাম থাকবে - গোরস্থানের পথে ১ 🙁
    ওহ 😮
    আমার তো ক্যামেরাও নাই :(( :((
    সমস্যা নাই AMLO চিফ এর কাছ থেকে নিয়ে আসবো B-)

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    ভাইয়া, সাবলীল একটা সূচনা, সাথের ছবিগুলো যেন লেখাটাকে আরো প্রাণবন্ত করেছে।
    অফটপিকঃ একটা কিছু বাদ পড়েছে মনে হচ্ছে। এই সিরিজে কি আপনার গোপন অভিসারের কোন কথা থাকবে না, উইথ ছবি?? 😛 😛
    :frontroll: :frontroll:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।