দি অ্যাক্সিডেন্টাল ওটার – ২

এবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তুলে ধরতে চাই। শিল্পীর স্বাধীনতার জন্য যত ধরণের সৌভাগ্য দরকার তার অনেকগুলোই যে কারণে অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইরানে চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে সেই সেন্সরশিপের সম্পর্কটা কেমন?

গত দশ বছর ধরে সরকার আমার কোন সিনেমাই দেখাতে দিচ্ছে না। আমার মনে হয়, তারা আমার সিনেমা বোঝেই না। কি সেন্সর করতে হবে আর কি করতে হবে না এটা না বোঝার কারণে তারা সবকিছুই আটকে দেয়, যাতে তারা চায় না এমন কোন তথ্যই সাধারণ মানুষের কাছে যেতে না পারে। সব সিনেমা আটকে দেয়াই তো সবচেয়ে নিরাপদ। সরকার এমন সব সিনেমাকে সমর্থন জোগায় যেগুলোর ধরণ-ধারণ আমার সিনেমা থেকে অনেক আলাদা, সেগুলোকে বলা যায় মেলোড্রামা। সরকার যে শুধু সিনেমার মালিকই তা না, সিনেমা বানানোর উপকরণও সব তাদের হাতে। এজন্য আমাকে তাদের আশেপাশে থেকেই কাজ করতে হয়। তারা আমার কাজে কোন বাঁধা দিচ্ছে না, কিন্তু কোন ধরণের সহযোগিতাও করছে না। আমরা একেবারে ভিন্ন জগতে বাস করি। দুটি বিষয় মনে রাখতে হবে: ইরানী কর্মকর্তরা খুব বেশী দিন এক দপ্তরে থাকে না, সিনেমা বিষয়ক দপ্তরগুলোতে যখন এক কর্মকর্তা গিয়ে আরেকজন আসে তখনই আমরা পূর্বের নিষিদ্ধ প্রকল্পের কাজ আবার শুরু করার কথা ভাবতে পারি। আমার দুটি সিনেমা সেন্সরশিপের কবল থেকে রেহাই পেয়েছিল, কারণ সম্ভবত কি সেন্সর করতে হবে সেটা তারা একেবারেই বুঝতে পারেনি। আমার মনে হয়, একটি সিনেমাকে তখনই ভাল বলা যায় যখন সেন্সর বোর্ড তাতে কি সেন্সর করতে হবে সেটা বুঝে উঠতে পারে না। সিনেমা বানানোর পর যদি সেন্সর বোর্ড কিছু অংশ কেটে দেয়, তাহলে বুঝতে হবে, সে অংশটা কেটে ফেলাই উচিত ছিল। কারণ সেন্সর বোর্ড সেই অংশটা বুঝে ফেলেছে।

এ প্রসঙ্গে আরেকটা কথা না বললেই নয়। শুধু অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিষয়বস্তুর কারণেই ইরানী সিনেমা অন্য সব সিনেমা থেকে আলাদা নয়। এই অনন্যতার আরেকটি বড় কারণ, ইরানী সিনেমা দেখলে বোঝা যায়, এখানকার পরিচালকরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই কিভাবে নিজেকে প্রকাশ করার উপায় বের করেছেন। অনেকে সেন্সরকে উৎপীড়ন হিসেবে দেখেন, কিন্তু আমি একে দেখি বাস্তব অবস্থা হিসেবে, যে অবস্থার মধ্যে আমাকে কাজ করতে হচ্ছে। আমি অবশ্যই জানি, বিভিন্ন পরিস্থিতি বিচারে উৎপীড়নের বিভিন্ন অর্থ হতে পারে। কিন্তু চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে মনে করি, এই সীমাবদ্ধ গণ্ডিটাই আমার বাস্তবতা, যে বাস্তবতা থেকে মুক্তির কোন উপায় নেই। শুধু সিনেমা না, পুরো জীবনের প্রেক্ষিতেই সীমাবদ্ধতা মেনে নেয়াটা জরুরী। এটা সবসময়ই ছিল এবং আছে। সীমাবদ্ধতা ছাড়া প্রাচ্যের জীবন কল্পনাও করা যায় না। আমাদেরকে সবসময়ই নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে বাস করতে হয়েছে। সীমাবদ্ধতা এবং মুক্তি- এ দুয়ের সমন্বয় ও লেনদেনই জীবন। কাজকর্ম ও ক্ষমতার ক্ষেত্র বড়ই সসীম। ছোটবেলায় আমাদেরকে সবসময় বলা হতো, এটা করতে পারবে, এটা করতে পারবে না। এমনকি যা করতে পারব সেটা করে আমরা সর্বোচ্চ কতদূর পর্যন্ত যেতে পারি সেটাও বলে দেয়া হতো।

এর সবচেয়ে ভাল উদাহরণ আমাদের ক্লাসরুম। রচনা লেখার সময় শিক্ষক যখন কোন নির্দিষ্ট বিষয় দিয়ে দিতেন তখন আমরা বেশ দ্রুতই মানসম্পন্ন কিছু একটা লিখে দেখাতে পারতাম। কিন্তু যখন কোন বিষয় দিতেন না, আমাদের উপর ছেড়ে দিতেন, তখন লেখার মত কিছুই খুঁজে পেতাম না। সীমা এবং সীমাবদ্ধতা কতটুকু- এটা না বলে দিলে আমরা কিছু করতে পারি না। এটাই আমাদের সংস্কৃতির প্রকৃতি এবং চলচ্চিত্র শিল্পেও এর প্রভাব পড়েছে। উদাহরণ হিসেবে ইরানী বিপ্লবের পরবর্তী চার বছরের উল্লেখ করা যায়। সে সময় সিনেমা শিল্পে খুব হট্টগোল হচ্ছিল, কারণ কোন নিয়ম-নীতিই তখন পর্যন্ত তৈরী করা হয়নি। কোন নিয়ম না থাকায় সে সময় অনেক কিছুই করা যেতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে ইরানী প্রযোজক ও পরিচালকরা সে সময় খুব বেশী সিনেমা করেননি। কেউ সুযোগটা কাজে লাগায়নি, কারণ সবাই সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানার জন্য অপেক্ষা করছিল।

আমি বলছি না, এই সীমাবদ্ধতা ভাল এবং এটা থাকা উচিত। আমার কথা হচ্ছে, আমরা এই বাস্তবতা মেনেই বেড়ে উঠেছি, আমাদের মানসিকতা সেভাবেই তৈরী হয়েছে। শুধু আমার পেশা না, সব পেশার জন্যই এই কথাটা সত্য যে, সীমাবদ্ধতা মানুষকে আরও সৃজনশীল করে। আমার এক স্থপতি বন্ধু আছে। সে বলে, অড লট এর জন্য স্ট্রাকচার ডিজাইন করার সময়টা তার সবচেয়ে ভাল যায়। কারণ এই টুকরো টুকরো জমিগুলো সাধারণ গড়নের মধ্যে পড়ে না, এবং এক্ষেত্রে তাকে অনেক সীমাবদ্ধতা মেনে কাজ করতে হয়। এজন্যই তাকে সৃজনশীল হতে হয় এবং সে এটা উপভোগও করে। এ ধরণের সীমাবদ্ধতাগুলোই আসলে মানুষকে সৃজনশীল হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

কান চলচ্চিত্র উৎসবে “আ টেস্ট অফ চেরি” দেখানোর আগে আগে ধারণা করা হচ্ছিল যে, ইরানী কর্তৃপক্ষ এটা আটকে দিতে পারে, কারণ এতে আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী অনেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিষয়বস্তুর কারণে কোন সমস্যা হয়নি। বিষয়বস্তুর কারণেই কি এই সিনেমার সেন্সর নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল?


এ নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছিল। কিন্তু পরে আমি যখন কর্তৃপক্ষের সাথে নিজে কথা বলি তখন তারা মেনে নেয়ে যে, সিনেমার বিষয়বস্তু আসলে আত্মহত্যা না। এর বিষয়বস্তু জীবনের পছন্দ নিয়ে। জীবন আমাদের জন্য আবশ্যক না, আমরা চাইলে যে কোন সময় জীবন শেষ করে দিতে পারি। একটি দরজা সবসময়ই আছে, চাইলেই তা খুলতে পারি। কিন্তু আমরা বেঁচে থাকাই পছন্দ করি, চলে যেতে চাই না। এই পছন্দই আমার মতে স্রষ্টার দয়া। এই বেছে নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছেন বলেই স্রষ্টা দয়ালু। এই ব্যাখ্যা কর্তৃপক্ষ মেনে নিয়েছিল। রুমানীয়-ফরাসি দার্শনিক E. M. Cioran এর একটি উক্তি সে সময় আমাদে অনেক সাহায্য করেছিল: “আত্মহত্যার সম্ভাব্যতা না থাকলে, আমি হয়ত অনেক আগেই নিজেকে মেরে ফেলতাম।” “আ টেস্ট অফ চেরি” সিনেমার বিষয় হল বেঁচে থাকার সম্ভাব্যতা এবং বেঁচে থাকাকে পছন্দ করা। জীবন আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়নি: এটাই সিনেমার মূল থিম।

আমি কি জানতে পারি, ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পরও আপনি কেন ইরানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? আপনার প্রজন্মের অনেক চলচ্চিত্রকারই তো চলে গিয়েছিলেন।

একটি গাছকে তার মূল থেকে উপড়ে ফেলে অন্য কোথাও নিয়ে গেলে সে আর ফল দেবে না। আর দিলেও তার ফল আগের মত ভাল হবে না। এটা প্রকৃতির নিয়ম। আমার মনে হয়, মাতৃভূমি ত্যাগ করলে আমার অবস্থা এই গাছের মতই হতো।

আপনার সিনেমা বিপ্লবের পর ইরানের বাস্তবতা সঠিকভাবে তুলে ধরতে পেরেছে বলে মনে করেন কি?

না, এ সম্পর্কে একেবারেই নিশ্চিত না। আমার সিনেমা ইরানে জীবনের বাস্তবতা দেখাতে পারে কিনা এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই; আমি জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরি। ইরান অনেক বড় দেশ, তাছাড়া দিন দিন এর ব্যাপ্তি আরও বাড়ছে। মাঝেমধ্যে আমরা যারা ইরানে থাকি তাদের পক্ষেও অনেক বাস্তবতা উপলব্ধি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

আপনি নিজে কি ধর্ম পালন করেন?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না। আমি মনে করি ধর্ম খুব ব্যক্তিগত বিষয়, এবং দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশে ধর্মের ব্যক্তিগত দিকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। ধর্ম পালন করি- আমার জন্য এটা বলার মত সোজা কাজ আর কিছু নেই, কিন্তু আমি বলব না। আমাদের জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত এই বিষয়টাই এখন সরকারকে শক্তি যোগান দেয়ার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এখানে কে কতটা ধার্মিক তার মাধ্যমেই মানুষের মূল্য নির্ধারিত হয়।

আপনার প্রায় সব সিনেমাতেই মুখ্য চরিত্রটি থাকে পুরুষ। কড়া ধর্মীয় অনুশাসনকে কি এর একটি কারণ বলা যায়?

ধর্মীয় সীমাবদ্ধতা বাদ দিলেও বলতে হয়, আমি আসলে মা বা প্রেমিকা হিসেবে নারীর ভূমিকা একেবারেই পছন্দ করি না। এছাড়া সহিংসতা বা দীর্ঘমেয়াদী ভোগান্তির শিকার হিসেবেও নারীর ভূমিকা ভাল লাগে না। আমার অভিজ্ঞতাও সেরকম না। নারীকে ব্যতিক্রমী হিসেবে দেখাতে পছন্দ করি না। আমি আসলে কখনোই ব্যতিক্রমী কিছু দেখাই না। বিশেষ করে নায়কোচিত চরিত্রে নারীর ভূমিকা বাজে লাগে, কারণ এটা বাস্তবতা বিবর্জিত। সিনেমায় নারীকে আরেকটি ভূমিকায় দেখা যায়, সেটা হল সাজানোর বস্তু- শুধু ইরান না বিশ্ব চলচ্চিত্রেও এর ব্যাপক প্রভাব আছে। এ ধরণের কোন ভূমিকাই আমার ভাল লাগছে না, তাহলে আর বাকি থাকল কি? আমি অবশ্য “টেন” এর মুখ্য চরিত্রে একজন নারীকে উপস্থাপন করেছিলাম।

এই সিনেমার কাহিনী কি আপনার বৈবাহিক জীবন থেকে অনুপ্রাণিত?


অবশ্যই। আমি নিজে যার অভিজ্ঞতা অর্জন করিনি তা কখনও দেখাই না, বা তার প্রতিফলনও ঘটাতে চাই না। আমি ডিভোর্স করেছিলাম ২২ বছর আগে। নারী নির্যাতন বা মাদকাসক্তির অভিযোগেই কেবল ইরানী মেয়েরা স্বামীর বিরুদ্ধে ডিভোর্সের মামলা করতে পারে। কিন্তু ডিভোর্সের পর সন্তানদের দেখাশোনা করার মত আর্থিক অবস্থা তাদের থাকে না। তাই ছেলেমেয়েদের সাথে তখন তাদের খুব কমই দেখা হয়। ডিভোর্সের পর তারা স্বাধীনতা হারায়, এবং দিন দিন সন্তানদের ভরণপোষণের ক্ষমতা আরও কমতে থাকে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট সবাই ভোগান্তির শিকার হয়। “টেন”-এ আমি এই বিষয়টাই তুলে ধরতে চাচ্ছিলাম।

স্বামীকে ডিভোর্স করা একজন মহিলা গাড়িতে করে তেহরানের রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন যাত্রী নিয়ে: তার ছেলে, বন্ধু, একটি পতিতা এবং এক বৃদ্ধ মহিলা। তার ছোট্ট ছেলের মাধ্যমেই আমি ডিভোর্সের ফলাফলগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ছেলেটির ব্যবহার বেশ উগ্র এবং প্যাসেঞ্জার সিটে বসে সে তার মা’র সাথে খারাপ ব্যবহার করে। মাত্র সাত বছর বয়সেই এই ছেলেটি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ম্যাসকুলিন লাইসেন্স পেয়ে গেছে। অনেকে একে “সেক্সিস্ট”-ও বলে থাকেন।

আপনি অনেক সিনেমাতেই সাধারণ মানুষদের দিয়ে অভিনয় করান যারা আগে কখনোই অভিনয় করেনি। এরা প্রত্যেকে আবার নিজেদের বাস্তব জীবনের চরিত্রেই অভিনয় করে। এর কারণ কী?

অপেশাদারদের সাথে কাজ করার একটি বিশেষ সুবিধা আছে, তারা আমার চিত্রনাট্য ঠিক করে দিতে পারে। এ কারণেই তাদের ব্যবহার করি। আমি কিছু লেখার পর তাদের দিয়ে বলাই, যদি দেখি তারা স্বাভাবিকভাবে বলতে পারছে না তখনই বুঝে যাই লেখায় সমস্যা আছে। সিনেমা শ্যুট করার পুরো সময়টাতেই অপেশাদার অভিনেতারা “হস্তক্ষেপ” করে। এবং সবশেষে তারাই আমাকে অপেক্ষাকৃত ভাল একটা সিনেমা বানাতে সাহায্য করে। আমি এটা বোঝাতে চাচ্ছি না যে, পেশাদারদের দিয়ে অভিনয় করানোটা নেতিবাচক। আমার কথা হচ্ছে, আমি চরিত্রটির ব্যক্তিত্ব এভাবেই তৈরী করি, এটা আমার পদ্ধতি। সাধারণত পরিচালকরা সাধারণ মানুষের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তারকা নিয়ে আসে, কিন্তু আমি সাধারণ মানুষদের নিয়ে আসি যারা নিজেদের চরিত্রেই অভিনয় করে। তারা কেউই নিজেরটা ছাড়া অন্য কারও চরিত্রে অভিনয় করতে পারবে না। একটা প্রচলিত কথা আছে, নিজের প্রেম নিয়ে লিখলে যে কারও পক্ষেই রোমান্টিক লেখক হওয়া সম্ভব। এজন্যই এই অপেশাদার অভিনেতারা বেশ ভাল করছে, কারণ তাদেরকে নিজের চরিত্রেই অভিনয় করতে হয়, অন্য কারও না। দৃশ্যটা বুঝিয়ে দেয়ার পর পরই তারা কথা বলা শুরু করে, অনেক সময় আমার কল্পনাকেও হার মানায়। অনেকটা চক্রের মত, কোথায় এর শুরু আর কোথায়ই বা শেষ তা জানি না: আমি তাদেরকে কি বলতে হবে শেখাচ্ছি নাকি তারাই আমাকে কি গ্রহণ করতে হবে তা শেখাচ্ছে, তাও জানি না।

সিনেমার দর্শকদের সাথে এই অভিনেতাদের সম্পর্ক কী?

অপেশাদাররা বেশী কিছু করে না এবং এটাই আমার চিত্রনাট্যের সাথে খাপ খায়। আমার চিত্রনাট্যও সবকিছু বানান করে বুঝিয়ে দেয় না। অপেশাদার অভিনেতা ব্যবহার করা এবং তাদের উপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে চিত্রনাট্য লেখা- এই দুটো কাজ দর্শকদেরকে সিনেমার নির্মাণ প্রক্রিয়ায় আরও বেশী অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়। আমি “অর্ধ-নির্মিত সিনেমার” পক্ষে, যে ধরণের সিনেমার বাকিটা দর্শকরা তাদের মন দিয়ে পূর্ণ করে। ভবিষ্যতের সিনেমা হচ্ছে পরিচালক ও দর্শকের সিনেমা। আমি চলচ্চিত্রকার হিসেবে একটি সিনেমা বানাই, কিন্তু দর্শকরা সেটার উপর ভিত্তি করে নিজেদের মনে ১০০ টি সিনেমা বানায়। প্রতিটি দর্শকই নিজের সিনেমা বানাতে পারে। আমি ঠিক এটাই চাই। মাঝেমাঝে আমার সিনেমার দর্শকরা যখন আমাকে তাদের মানসিক সিনেমার কথা শোনায় তখন আমি বিস্মিত হই। তারা যখন বর্ণনা করে, তখন আমিই তাদের সিনেমার শ্রোতা হয়ে যাই। আমার সিনেমা তখনই কাজ করবে যখন একে দর্শকদের সিনেমা বানানোর ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। পারস্যের একটি বচনের সাথে এটা খুব মিলে যায়: “ধার করা চোখ দিয়ে দেখা”। এর মাধ্যমে আমার উদ্দেশ্যটা ব্যাখ্যা করা যায়: আমি চাই দর্শকরা পর্দায় ইতিমধ্যেই ভেসে ওঠা ছবিগুলো দেখুক এবং তাদের ধার করা চোখের মাধ্যমে এমন কিছু কল্পনা করুক যা দৃশ্যের বাইরে রয়েছে। বিষয়টা আরেকভাবে বলি: চলচ্চিত্রের সাধারণ পদ্ধতি হচ্ছে- কিছু দেখানো এবং কিছু বলা। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন সিনেমা তৈরী করা যা দেখলে বোঝা যাবে- কোনকিছু দেখানো বা বলা ছাড়াই আমরা সে সম্পর্কে কতদূর অগ্রসর হতে পারি, দর্শকদের কল্পনাশক্তি কতটুকু ব্যবহার করতে পারি। আপনাকে অবশ্যই ভৌতভাবে যতটুকু দেখানো হচ্ছে তার বাইরেও কল্পনা করতে হবে, কারণ আমরা কেবল এক চিলতে বাস্তবতা দেখাই, বাকিটা থাকে দৃশ্যের বাইরে। চিন্তাধারাটা ভাল- ছবি এবং ক্রিয়ার মাধ্যমে দেখানো হয়নি এমন বিষয়গুলো দেখতে সাহায্য করা। আমি ব্রেসোঁর নীতিতে বিশ্বাসী: সংযোজন নয় বরং বর্জনের মাধ্যমে সৃষ্টি।

এ কারণেই কি আপনার সিনেমা অনেক সময় ইচ্ছে করেই অসমাপ্ত রাখা হয়? যেমন আ টেস্ট অফ চেরি।

হ্যাঁ। কোন একটা উপসংহারের মাধ্যমে সিনেমা শেষ না করার চিন্তাটা আমার মাথায় কয়েক বছর আগে এসেছিল। অধিকাংশ সময়ই দর্শকরা এ আশা নিয়ে সিনেমা দেখতে যায় যে, একটা গল্প বলা হবে। গল্পের বক্তা হিসেবে আমি এবং সিটে বসে সেই গল্প উপভোগ করতে থাকা দর্শকের মধ্যে এই বিভাজন আমি পছন্দ করি না। বরং এটা ভাবতে ভালবাসি যে, দর্শকরা আরও বেশী বুদ্ধিমান। এ কারণেই আমি দুই ঘণ্টা তাদেরকে বন্দি করে রেখে গল্প শোনানো এবং আমি যেভাবে চাই ঠিক সেভাবেই গল্পটা শেষ করে দেয়ার পক্ষপাতি নই। সুতরাং আমি আসলে তাদেরকে বেশী ক্রেডিট দিতে চাই, সিনেমার সাথে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সৃষ্টি বা সৃষ্টির সাথে মিশে যাওয়ার উপলব্ধিটা জাগিয়ে তুলতে চাই। অনেক শিল্পী তাদের সিনেমা একেবারে নিখুঁত করতে চান, কিন্তু আমি সেরকম পূর্ণতা খুঁজি না। আমার কাছে পূর্ণতার সংজ্ঞা হচ্ছে, দর্শক সিনেমায় কতটুকু অংশ নিতে পারল সেটা। সুতরাং ভাল সিনেমা সেটাই যেটা দর্শককে বন্দি করে রাখে না বরং তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিতে পারে।

< < গত পর্ব

[চলবে…]

২১ টি মন্তব্য : “দি অ্যাক্সিডেন্টাল ওটার – ২”

  1. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)
    আমি বলছি না, এই সীমাবদ্ধতা ভাল এবং এটা থাকা উচিত। আমার কথা হচ্ছে, আমরা এই বাস্তবতা মেনেই বেড়ে উঠেছি, আমাদের মানসিকতা সেভাবেই তৈরী হয়েছে। শুধু আমার পেশা না, সব পেশার জন্যই এই কথাটা সত্য যে, সীমাবদ্ধতা মানুষকে আরও সৃজনশীল করে। আমার এক স্থপতি বন্ধু আছে। সে বলে, অড লট এর জন্য স্ট্রাকচার ডিজাইন করার সময়টা তার সবচেয়ে ভাল যায়। কারণ এই টুকরো টুকরো জমিগুলো সাধারণ গড়নের মধ্যে পড়ে না, এবং এক্ষেত্রে তাকে অনেক সীমাবদ্ধতা মেনে কাজ করতে হয়। এজন্যই তাকে সৃজনশীল হতে হয় এবং সে এটা উপভোগও করে। এ ধরণের সীমাবদ্ধতাগুলোই আসলে মানুষকে সৃজনশীল হওয়ার সুযোগ করে দেয়।

    অসাধারণ প্রকাশ! পেশা-কাজ নিয়ে এতো চমৎকার বিশ্লেষণ আমি আর আগে পড়িনি। প্রথম প্রশ্নটার জবাব পড়েই এই মন্তব্য করলাম। বাকিটা পড়ে আবার করবো মনে হচ্ছে। :salute: মুহাম্মদ।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  2. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)
    আমি মনে করি ধর্ম খুব ব্যক্তিগত বিষয়, এবং দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের দেশে ধর্মের ব্যক্তিগত দিকটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। ধর্ম পালন করি- আমার জন্য এটা বলার মত সোজা কাজ আর কিছু নেই, কিন্তু আমি বলব না। আমাদের জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত এই বিষয়টাই এখন সরকারকে শক্তি যোগান দেয়ার যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এখানে কে কতটা ধার্মিক তার মাধ্যমেই মানুষের মূল্য নির্ধারিত হয়।

    দেশ-সমাজ-পরিবার ভেদে ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ থেকে কারোরই মুক্তি নেই?


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  3. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

    দর্শকদের ব্যাপারে ওনার দৃষ্টিভঙ্গী খুবই ভালো লেগেছে। আর ধর্মের ব্যাপারেও ওনার কথার সাথে সম্পুর্ন একমত আমি। সেন্সরশিপের ব্যাপারেতো লাবলু ভাই বলেছেন আগেই। পেশাগত সীমাবদ্ধতাকে ইন্সপিরেশন হিসেবে কিভাবে ব্যবহার করা যায় তা উনি খুব ভালোভাবে দেখিয়েছেন।

    জবাব দিন
  4. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    এখন পর্যন্ত যতটুকু দিয়েছিস, তাতে কিছু জায়গায় তোর অনুবাদটা ভাল লেগেছে আবার কিছু জায়গায় মনিস রফিক ভালো করেছেন। শেষ করার পর বলবো পুর্নাংগ অনুবাদ কোনটা ভালো হয়েছে।

    কিয়ারোস্তমি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ছবি নিয়ে তার সকল চিন্তা ভাবনা আমার কাছে আদর্শ।

    'টেন' ছবিটা দেখিসনি মনে হয় তুই। দেখে ফেল, পুরো ছবিটা একটা গাড়ির মধ্যে।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
    • মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

      আমার মনে হয় আগে মনিস রফিকের পুরো অনুবাদটা পড়ে নিলে ভাল করতাম। আমি তার অনুবাদ পুরোটা পড়িই নাই। পুরোটা পড়লে তার সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী এই অনুবাদটা করতে পারতাম। যাহোক, শুরু যখন করে দিয়েছি তখন শেষ করেই ফেলি। শেষ হওয়ার পর বিস্তারিত জানায়েন।

      "টেন" দেখি নাই। আমি আসলে কিয়ারোস্তামির মাত্র তিনটা সিনেমা দেখছি: টেস্ট অফ চেরি, ক্লোজ-আপ, উইন্ড উইল ক্যারি আস। তিনটা দেখেই মুগ্ধ।

      জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।