স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট

মিশন এলাকায় একই স্থানে আবদ্ধ থাকতে থাকতে এবং একই কাজ করতে করতে একঘেয়েমি চলে আসে। এটা কাটানোর জন্য যৎকিঞ্চিত বিনোদনের যা ব্যবস্থা আছে তাও অপ্রতুল মনে হয়। তারউপর আছে পরিবার পরিজন থেকে দূরে থাকার কষ্ট। এই সবকিছু মিলিয়ে একটা মানসিক ক্লান্তি আমাদের সবার উপর ভর করে বসে যেটাকে সহজভাবে “স্ট্রেস” বলে আখ্যায়িত করা হয়। আর এটাকে কমানোর জন্য গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপই “স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট”।

আমরা যে স্থানে থাকি সেটা “কারী কমপ্লেক্স” (CARI = Central Agricultural Research Institute), এই দেশের কেন্দ্রীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। বেশ কয়েক বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এটা দেশের মোটামুটি মধ্যখানে অবস্থিত। কারী কমপ্লেক্স ছোটবড় পাহাড়ে ভরা। এক হিসেবে পাহাড় না বলে টিলা বলা ভালো। এখান থেকে সবচেয়ে কাছের শহরমতোন জায়গা যেটা আছে সেটা হল ‘বাঙ্গা’ (Gbranga)। সড়ক পথে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাবার পথে সীতাকুন্ড যতটুকু চোখে পড়ে তারচেয়েও ছোট এই স্থান।

চোখে পড়ার মতোন শহর যেটা আছে সেটা হল রাজধানী শহর ‘মনরোভিয়া’ (Monrovia)। কারী থেকে এর দূরত্ব মাত্র ২০০ কিমি। আর আমাদের স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট করতে হলে যাবার জায়গা এটাই। আমাদের অপারেশনাল ও অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ যাবতীয় কর্মকান্ডের হেড অফিস মনরোভিয়ায় অবস্থিত। প্রতি মাসে কম করেও ৭/৮ বার অফিসিয়াল মুভ করতে হয়। আর সেখানে আমরা বাই টার্ন যেয়ে ঘুরে ফিরে আসি।

এখানে দেখার মতোন যেই জিনিস আছে সেটা হলো অনেক ছোট ছোট সী বিচ। তা এমনই সী বিচ যে সেখানে নামা সম্পূর্ণ নিষেধ। সমুদ্র হঠাৎ খাড়া নেমে গেছে আর পাথুরে সৈকত। আমরা অফিসারের নের্তৃত্বে সৈনিকদের দল বেঁধে নিয়ে যাই সমুদ্র পাড়ে। সমুদ্রের বিশালতার সামনে এসে নিজেকে অতি ক্ষুদ্র আবিষ্কার করার পাশাপাশি মনে পড়ে যায় দেশে ফেলে আসা আত্মীয় স্বজনদেরকে – প্রিয়তমাকে। তখন মোবাইলে কল করে দু মিনিট কথা বলে সঙ্গ লাভের বাসনাটা খানিক পূরণ করি। এখানে আমরা ছবি তুলি, বড় জোড় পা ভেজাই। আর বাসায় গপ্পো দিই যে আটলান্টিক দেখলাম।

আমাদের মাঝের কারও কারও জন্য এটা অবিস্মরনীয় হয়ে থাকে এই জন্য যে তারা জীবনে প্রথম সমুদ্র দেখার সুযোগ এখানেই পেয়েছে। ক্যামেরার পিছনের মানুষ বলে প্রচুর ছবি উঠতে থাকে আমার হাতের ক্যামেরায়। মাঝে মাঝে ওদের হাতে ক্যামেরা দিয়ে ছেড়ে দিই। ওরা তখন শুয়ে – বসে, পরস্পর জামা কাপড় অদল বদল করে, সানগ্লাস চোখে দিয়ে – মাথায় তুলে ছবি তোলে। ইউনিটে ফেরার পর ব্ল্যাংক সিডি নিয়ে আমার কাছে মোটামুটি লাইন দিয়ে আসে সৈনিকরা ছবি সংগ্রহের জন্য। সবাইকে আগ্রহ নিয়ে সিডিতে ছবি রাইট করে দিই। আর কিছু হোক না হোক বহন করে নিয়ে যাবার মতোন এটাই স্মৃতি – ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি ‘ছবি কথা বলে’। আমাদের অনুপস্থিতিতে কেউ কেউ বিদেশী স্বল্পবসনা কাপলের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ছবিও তুলেছে। এই ছবি রাইট করিয়ে নেবার কয়েকদিন পর এসে সেই ছবি ডিলিট করার চেষ্টাও করেছে। আমি মুচকি হেসেছি মাত্র।

মনরোভিয়াতে যেয়ে সমুদ্র দেখে স্ট্রেস ম্যানেজ করা ভালো কিন্তু প্রবলেম হয় তখনই যখন মাসের মধ্যে একাধিকবার এই ২০০ কিমি বদখত পথ মিলিটারি ভেহিক্যালে আপ ডাউন করতে হয়। আর যাই হোক মিলিটারি জিপ, পিকাপ বা লরিতে আন্তঃ জেলা চেয়ার কোচের অনুভূতি পাওয়া যায় না। তখন “স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট” না হয়ে “স্ট্রেস এ্যারেঞ্জমেন্ট” হয়ে যায়। ইদানিং আমাদের অনেকের কাছেই “স্ট্রেস এ্যারেঞ্জমেন্ট” একটা বহুল ব্যবহৃত শব্দ। এই ব্যাপারটা আমার পরিচিতজনদের ভিতর সবচেয়ে ভালো অনুভব (হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছে বললে ভালো হয়) করেছে সিরাজ। গত আট মাসে ও অনুন্য ১৮ বার এই দীর্ঘ রাস্তা আপ ডাউন করেছে। এটা একটা রেকর্ড বলেই আমার মনে হয়। ওর তুলনায় আমি দুধভাত – মাত্র ৪ বার!!

২৪ টি মন্তব্য : “স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট”

  1. সাইফ (৯৪-০০)

    হ,ছুডু ভাইডারে ক ষ্ট দিয়া নিজে দুধ ভাত....

    ........সিরাজ দেখ তর কলেজ ভাই এর নমুনা............হা হা হা
    বস , এ স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট করতে গিয়া নিজেই স্ট্রেস এর মইধ্যে থাকি............।।

    জবাব দিন
  2. তাইফুর (৯২-৯৮)
    তখন “স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট” না হয়ে “স্ট্রেস এ্যারেঞ্জমেন্ট” হয়ে যায়

    অক্টোবর মিয়া যাইতেই চাচ্ছিল না। যদি বা গেল, এখন নভেম্বর মামু খেলা দেখাচ্ছে। আর ভাল লাগে না। আমার মনে হয় “স্ট্রেস এ্যারেঞ্জমেন্ট” হই গেছে।


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    সায়েদ ভাই, আমগো ইমরুল(ক্যাঃ ইমরুল, ইনফ্যান্ট্রি, ৫০তম লং) আছে লাইবেরিয়ায়। আপনার ধারে-কাছে হইলে ওরে একটু দেইখ্যা রাইখেন... O:-)


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

    আপনার যেন স্ট্রেস ম্যানেজমেন্টই চলতে থাকে। অ্যারেঞ্জমেন্ট যত কম হয় ততই ভালো। কারণ ম্যানেজমেন্ট হইলেই তো আমরা এভাবে ভীনদেশের গল্প শুনতে পারবো। ম্যানেজমেন্ট জিন্দাবাদ...
    চালায়া যান।

    জবাব দিন
  5. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    জোস,
    আমি সায়েদের পুরা ব্লগটারই প্রেমে পিরা গেছি। একেকটা একেক ডাইমেনশনের লেখা :boss: :boss:
    দোস্ত, peace keeping নাকি এখন peace enforcing ? তোর আগের লেখায় লাসা ফিভারটার কথা পইড়া পাওয়া ভয় এখনো কাটেনাই।
    মাসরুফের কথাটাই তাই কপি পেস্ট মারি

    দেশের বাইরে জীবন বাজী রাখা এই মানুষগুলোকে লাল সেলাম

    :salute: :salute:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।