সমুদ্রপারে তাদের পাড়ায় পাড়ায়

সমুদ্রপারে তাদের পাড়ায় পাড়ায়

 

লুমলে বীচ (LUMLEY BEACH)

 

“আজ রাত্রে আসিয়াছি নামি

এই দূর সমুদ্রের জলে!

যে নক্ষত্র দেখ নাই কোনোদিন, দাঁড়ায়েছি আজ তার তলে!

সারাদিন হাঁটিয়াছি আমি পায়ে পায়ে

বালকের মতো এক — তারপর, গিয়েছি হারায়ে

সমুদ্রের জলে,

নক্ষত্রের তলে!

রাত্রে, অন্ধকারে!” – জীবনানন্দ দাশ

 

দূর অতীতের স্মৃতি থেকে কোন কিছুকে বর্তমানকালে নিয়ে আসা প্রকৃতপক্ষেই যথেষ্ট কঠিন। নিত্য দিনের জীবনপ্রবাহ আমাদেরকে এতোটাই ব্যতিব্যস্ত করে রাখে যে, অতীতের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের মনের ভেতরে স্থান করে নিতে হিমশিম খায়। প্রতিদিন আমরা অসংখ্য নতুনের সংস্পর্শে আসি। অনেক নতুন নতুন বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়। শিখতে হয়। ফলে অতীতের বেশীরভাগ বিষয়ই বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যায়। পিঁয়াজের দূরতর খোসাদের মতন। হয়তো বা বিস্মরণই আমাদেরকে সামনের দিকে চলতে শিখায়। নতুবা অতীত চারিতা নির্দিষ্ট সময়ের আবর্তে আমাদেরকে বন্দী করে রাখতো। আমরা নিজেরাই এক সময়ে হয়ে উঠতাম বিস্মৃতির অংশ। এর পরেও কিছু কিছু স্মৃতি আছে যাদেরকে সময়ের প্রবাহ মুছে ফেলতে পারে না। এরা উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতন আমাদের মনের ভেতরে জেগে থাকে।

 

‘সমুদ্রের জলে দেহ ধুয়ে নক্ষত্রের তলে বসে আছি’! ঠিক তাই। গভীর নিশীথে পৃথিবী এখন স্তব্ধ। ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়ে শব্দ ছাড়া আর কোন পার্থিব শব্দ নেই। নক্ষত্রের আলো ছাড়া আর কোন জাগতিক বা মহাজাগতিক আলো নেই। আমার চারপাশের সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমার স্ত্রী, দুই মেয়ে–সবাই। এই মুহূর্তে আমার মন পড়ে আছে আটলান্টিক মহাসাগর তীরে। পশ্চিম আফ্রিকার যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ সিয়েরালিওন। এর রাজধানী ‘ফ্রি টাউন’ সন্নিকটবর্তী ‘লুমলে’ নামক অক্ষয় এক বেলাভূমিতে। আটলান্টিক মহাসাগরের বিস্তৃত সৈকতরেখা জুড়ে এই বেলাভূমি সমুজ্জ্বল কণ্ঠহারের মতন জ্বলজ্বল করছে। আদিকাল থেকে। পৃথিবীর কোন দুঃখ, দুর্দশা, মারামারি–হানাহানি একে কখনোই কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি। পেরে থাকলেও খুব সংক্ষিপ্ত সময়কালের জন্যে। সাগরের বুক থেকে বেলাভূমিতে আছড়ে পড়া দুই পরস্পর ঢেউয়ের মধ্যবর্তী সময়কালের জন্যে। আমার সম্বিত ফিরে আসে দূরাগত রেলগাড়ির হুইসেলের শব্দে। আমার বাসস্থান মহাখালী ডিওএইচ এস এর ইস্টার্ন রোডে। সারারাত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রেলগাড়ি আসে কমলাপুর স্টেশনে। আবার চলে যায়। হুইসেলের শব্দ এক সময়ে মিলিয়ে গেলেও রেল লাইনের ওপরে ট্রেনের অস্পষ্ট ঝাঁকুনির শব্দ জেগে থাকে অনেকক্ষণ। মনে হয় সমুদ্রের ঢেউ বেলাভূমি থেকে গর্জন করতে করতে মিলিয়ে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে।

 

সেনাবাহিনী তথা সামরিক বাহিনীর চাকুরীর একটা অসাধারন বৈশিষ্ট্য হল এই চাকুরী আপনাকে চমৎকার সব জায়গায় নিয়ে যাবে। অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করবে আপনাকে। যেগুলো সম্পর্কে আপনি অন্য কোন চাকুরিতে কস্মিনকালেও চিন্তা করেননি । এমনকি স্বপ্নেও না! এই জায়গাগুলোতে আপনার অবস্থান কাল হবে ন্যুনতম এক বছর বা তারও অধিক কাল। সুতরাং পর্যটকদের দৃষ্টি দিয়ে আপনি এই জায়গাগুলো দেখে নিজভূমে প্রত্যাবর্তন পূর্বক মনোজ্ঞ ভ্রমণ কাহিনী লিখবেন – তাও সম্ভব নয়। কারণ ন্যুনতম এক বছর বা তারও অধিক সময়কালের নিবিড় অবস্থান প্রকারান্তরে আপনাকে এই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দাতেই পরিনত করে দেবে। সেটা হতে পারে মেকং ডেলটার পাললিক মালভূমিতে। ইরাকের বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে।কুয়েতের আগ্নেয় শিলা গঠিত পাহাড় পর্বতে। বসনিয়া-হার্জেগভিনার বরফাচ্ছাদিত পর্বতের পাদদেশে।অতঃপর আপনি নির্বাসিত হবেন নন্দন তত্ত্বের পৃথিবী থেকে ঘোর বাস্তব এক পৃথিবীতে। এই পৃথিবীতে আছে পারস্পারিক হানাহানি, প্রতিনিয়ত রোগব্যাধি, জরা ও প্রতিকুল আবহাওয়া। এদের বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্যে আপনাকে গ্রহণ করতে হবে প্রানান্তকর প্রয়াস। এক সময়ে আপনার মনে হবে যে আপনি এই বৈরি/প্রতিকূল প্রতিবেশেরই একজন হয়ে গেছেন। অথবা আগে থেকেই ছিলেন। আপনার কাছে আপনার কর্তৃক ইতিপূর্বে যাপিত নিস্তরঙ্গ আনন্দিত জীবন আর ভালো লাগছেনা। ফলে ভ্রমণ কাহিনী লেখার মতন মন মানসিকতাও আপনার লোপ পাবে। একারণেই যুদ্ধের অপারেশনাল ইতিহাস পাওয়া গেলেও এর ভেতরে যাপিত জীবনের ইতিহাস আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যায়।

 

২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ব্যানসিগ-২ (বাংলাদেশ সিগন্যাল ব্যাটালিয়ন-২)এর অগ্রগামী দলের সদস্য আমরা কয়েকজন। কর্নেল আসিফ(ইউনিট অধিনায়ক), লেফটেন্যান্ট কর্নেল মামুন খালেদ, মেজর দিদার, মেজর সাইদুল এবং আমি। আটলান্টিকের ওপারের ‘লুঙ্গি বিমান বন্দর’ হতে রাশিয়ান হেলিকপ্টারে করে ১৫ মিনিট দূরত্বে অবস্থিত ফ্রি টাউনের ‘এবারডিন’ হেলিপ্যাডে অবতরণ করেছি। আকাশ থেকে অবতরণের অব্যবহিত পরেই বুঝতে পারলাম দুর্ভোগ আমার আর সাইদুল স্যারের পিছু নিয়েছে। কারণ লুঙ্গি বিমান বন্দরে আমাদের চার্টার্ড প্লেন হতে আমাদের দুজনের লাগেজ নামানোই হয়নি। নিজস্ব ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া ব্যাটালিয়নের অপারেশনাল এবং নন-অপারেশনাল লাগেজগুলোর মধ্য হতে এগুলোকে পৃথক করে আমাদের নিকটে পৌছাতে আগামীকাল বিকেল নাগাদ লেগে যেতে পারে। অবশ্য আমার দেখা মানুষদের ভেতরে সৈয়দ কামরুজ্জামান স্যার ‘বাই ডিফল্ট’ একজন ভাগ্যবান মানুষ। কোন এক অজানা সৈনিক তাকে ভালবেসে তার লাগেজ প্লেন থেকে নামিয়ে হেলিকপ্টারে তুলে দিয়েছে। আজ বিকেলে আমাকে আর সাইদুল স্যারকে জামান স্যারের জামাকাপড় পরেই রাত্রিযাপন করতে হবে। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে জামান স্যারের শার্ট এবং পায়জামা দুটোই যথাক্রমে আমার দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের দেড় থেকে দুইগুণ। আমরা তাকে পাকিস্তানের এককালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের যৌবনকালের সংস্করণ বলে মনে করে থাকি। ভয় পাই। অবশ্য এই পুরো দলের ভেতরে আমি এবং সাইদুল স্যার এই দুজনেই আকৃতিতে খর্বাকার। কর্নেল আসিফ ও মেজর জামান দেখতে আর্য বংশোদ্ভূত, দিদার স্যার আর মামুন স্যার দ্রাবিড় বংশোদ্ভূত এবং সাইদুল স্যারের গায়ের আভা মঙ্গোলিয়ানদের মতন। দেখতে অনেকটা জাপানী লেখক হারুকি মুরাকামির মতন লাগে। শুধুমাত্র আমিই বাঙালী। বায়ান্ন, উনসত্তুর এবং একাত্তুরে আমিই প্রাণ দিয়েছি। ভাষা, স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার জন্যে!

 

অধিনায়ক ব্যানসিগ-১, কর্নেল সিদ্দিক হেলিপ্যাডে আমাদেরকে রিসিভ করতে এসেছেন। ‘লুঙ্গি’ এয়ারপোর্টে এসেই শুনেছি তিনি ‘ফ্রি টাউন’ থেকে ১০/১২ কিলোমিটার দূরে ‘গডরিচ’ নামক মরুক্রান্ত পাথুরে এক অজ পাড়াগাঁয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটা মরূদ্যান গড়ে তুলেছেন। তাঁর পক্ষে এটা সম্ভব তা আমি শোনামাত্র সাথে সাথেই বিশ্বাস করে নিয়েছি। কারণ নব্বইয়ের দশকে তিনি ঢাকা সেনানিবাসে ইউনিট অধিনায়ক থাকাকালে প্রকৃতির প্রতি তাঁর নিখাদ ভালবাসার নির্যাস দিয়ে ইউনিট এলাকাকে নান্দনিক বোটানিক্যাল বা বলদা গার্ডেনে পরিণত করেছিলেন। নির্জন দুপুরে সেখানে ঘুঘু পাখির ডাক শোনা যেতো। সন্ধ্যের পর এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময়ে গা ছমছম করতো।প্রচণ্ড রকমের বাৎসল্য পরায়ণ মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমি তাকে ভয় পাই। কারণ আমার জানামতে তার এই বাৎসল্য প্রাথমিকভাবে শুধুমাত্র তার ইউনিটের কনিষ্ঠ অফিসারদের ভেতরেই বন্টিত হয়ে থাকে। সাইদুল স্যার তিনি ইউনিটে উপ অধিনায়ক থাকাবস্থায় কনিষ্ঠতম অফিসার ছিলেন। জীপে করে গডরিচে গমনের সময়ে তিনি মূলতঃ সাইদুল স্যারের সাথেই কথা বলছেন এবং কৌতুক করছেন। অজানা কোন কারণে কর্নেল আসিফও আমার মতই তাকে সমীহ করে চুপচাপ আছেন!

 

হেলিপ্যাড থেকে বের হবার পরই লুমলে বীচ রোডের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে লুমলে বীচ। সাদা এবং সোনালী বালুকনা দিয়ে তৈরি এই সৈকত বিকেলের আলোতে মনোহারী এক রুপ ধারন করেছে। আগামী এক বছর প্রতিদিন সকালে দলবেঁধে দৌড়াতে দৌড়াতে এই সৈকতে আসব। মনের আনন্দে এর নরম বালিতে হেঁটে বেড়াবো। এর স্বচ্ছ জলে সাঁতার কাটবো। ছেলেবেলায় পগারের জলের পিঠ হালকা স্পর্শ করে ঢিল ছুড়ে মারার মতন সমুদ্রের জলের ওপর দিয়ে নুড়ি পাথর ছুড়ে মারবো। সেই নিক্ষিপ্ত পাথর ব্যাঙের মতন লাফিয়ে লাফিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের অপর তীরের দিকে চলে যাবে। অপর তীরে দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিল। আমাজন বন আর প্রিয় ফুটবল খেলোয়াড় পেলের দেশ। এই বেলাভূমিতে দাঁড়িয়েই গভীর নিশীথে নক্ষত্র ভরা রাতে তারার মেলার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাববো হানাহানিমুক্ত পৃথিবীর কথা। এই ভারাক্রান্ত দেশ এবং স্বদেশের কথা।

৪,৮২৫ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।