ক্রিকেট@ক্যাডেট কলেজ


ক্যাডেট কলেজের অনেকগুলো নিয়মিত খেলার মধ্যে কিন্তু ক্রিকেট নেই। আমরা সাধারাণত ফুটবল, বাস্কেটবল, ভলিবল খেলি প্রতিদিনের গেমস টাইমে। কিন্তু ক্রিকেট এর জনপ্রিয়তা কোন অংশেই এখানে কম নয়। আমরা কলেজে ঢুকেছিলাম ৯৬ এর বিশ্বকাপের পর। তখন থেকে বাংলাদেশে ফুটবল কে পিছনে ফেলে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়তির দিকে। আমরাও তা থেকে ব্যতিক্রম নই। তাই কলেজে গিয়ে সেটা নেই দেখে খুব নিরাশ হয়েছিলাম। কিন্তু ক্যাডেটদের প্রতিভার মুগ্ধ দর্শক আমরা কিছুদিনের মধ্যেই ক্রিকেট খেলার অনেক গুলা ভার্সন পেয়ে গেলাম।

আমার অভিজ্ঞতা থেকে ক্যাডেট কলেজের ক্রিকেট এর ৪টা ভার্সন এর কথা বলছি এখানে।

১। ফরমাল ক্রিকেটঃ সবচেয়ে কম খেলা হয় এই ফরমাল ক্রিকেট। বছরে একবার হাউস কম্পিটিশন কে সামনে রেখে আগে পিছে ২ সপ্তাহ প্র্যাকটিস হয়। একেবারে কাঠের বল দিয়ে প্যাড পরে বিশাল মাঠে একেবারেই আমাদের চেনাজানা ক্রিকেট। এ ছাড়াও মাঝে মাঝে ক্লাস ১১, ১২ শুক্রবারে এই খেলার পারমিশন যোগাড় করে এবং সারাদিন খেলে। যারা খেলে না তারাও ভাব মারতে ওখানে গিয়ে বসে থাকে। এই ক্রিকেট নিয়ে অনেক মজার মজার কাহিনীও ঘটে সেটা অন্য কোনদিন।

২।রুম ক্রিকেটঃ এই ভার্সনটা কলেজের সবচেয়ে জনপ্রিয় ভার্সন। রুমের মধ্যেই খেলা হয়। বল হিসেবে প্রায়ই পিংপং বল এবং ব্যাট হিসেবে কখনো খাতা কখনো টেবিলের পা রাখার কাঠ কখনো বা টেবিলটেনিস ব্যাট। এই খেলার সবচেয়ে মজার দিক হলে অনেক সময় এটা ফ্লাড লাইটের আলোতেও খেলা হয়। এমন কি তখন জানালা দরজা কম্বল দিয়ে ঢেকে রেখে রাতের ২-৩ টার দিকেও খেলা হয়। এই খেলার সময় লক্ষ্য রাখতে হয়ে জুনিয়র থাকতে জুনিয়র হাউস প্রিফেক্ট আসল কিনা এবং সিনিয়র দের জন্য স্যার চলে আসল কিনা। অবশ্য সিনিয়র রা সাধারণত এই খেলাটাকে একটু জুনিয়র জুনিয়র কাজ ভাবে। তারা নিচের দুইটা ভার্সন পছন্দ করে।

৩। করিডোর ক্রিকেটঃ হাউসের বিভিন্ন যায়গায় লম্বা করিডর হল এই ভার্সন এর পিচ। এবং বলা বাহুল্য এখানে পিচ ছাড়া আর কিছু নাই। সেখানেই একজন ব্যাট করে আরেকজন বল আর পিচের উপরই একগাদা ফিল্ডার। এই ব্লগে আমি একটা করিডর ক্রিকেট এর ছবি দিয়ে দিলাম। এখানে বল হিসেবে আরেকটু উন্নত বল ব্যবহার হয়। মুজা দিয়ে বলটা বানানো হয় এবং টেপ দিয়ে খুব ভাল করে পেচানো হয়। তার আগে রশির ও একটা ব্যবহার আছে। এই বলের জন্য জুনিয়র দের অনেকেই অনেক সময় মুজা রোদে দিয়ে পরে আর খুঁজে পায়না। এটাতে লক্ষ্য রাখতে হয় যাতে আশে পাশের রুমের জানালার কাঁচ না ভাঙ্গে আর হাউস বেয়ারাকে পোষ মানিয়ে রাখতে হয়। নইলে ডিউটি মাষ্টার এর কাছে রিপোর্ট চলে যায়।

করিডোর ক্রিকেট

৪। ক্যান্টিন ক্রিকেটঃ এটা করিডোর ক্রিকেট এর আরেকটু উন্নত ভার্সন। হাউসের খোলামেলা জায়গায় একটু ক্রিকেট স্বাদ। এখানেও প্রায়ই মুজার বলই ব্যবহার হয়। তবে মাঝে মাঝে কেউ কেউ ডেয়ারিং হয়ে লুকিয়ে নিয়ে আসা টেনিস বল ও ব্যবহার করে। তবে টেনিস বল ব্যবহারের অসুবিধা হল বল বেশি দূরে চলে যায় কিংবা জানালার কাঁচ ভেংগে যায় ধরা পড়া সহজ হয়ে যায়। এখানে ব্যাট হিসেবে খাটের নিচের কাঠকে বিভিন্নভাবে সাইজ করে বানানো ব্যাট ব্যবহার হয়। এটা ক্লাস ১১-১২ এ না উঠলে খেলা যায়না। এবং ডিউটি মাষ্টার এর উপর অনেক অংশে নির্ভর করে।

এই গুলা ছাড়াও আরেকটা ভার্সন আছে সেটা হল খাতা কলম ভার্সন। আমরা যখন সেভেনে পড়তাম তখন খেলতাম বই উলটিয়ে উলটিয়ে একজন বল করত। বই এর পেজ এর লাস্ট ডিজিট টা থাকত রান। আর ব্যাটসম্যানের কোন কাজ নেই। এইভাবে একজন একজন করে রান করা। সেটার আপডেট ভার্সন আসল পরে ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে। ক্যালকুলেটর এর রেন্ডম নাম্বার ব্যবহার করে। পরবর্তিতে আমরা একবার লটারী ভার্সন ক্রিকেট খেলতাম তখন আমরা ক্লাস ৮ এ। সেটার নিয়ম হল একটা বক্সে টুকরা টুকরা করে কিছু কাগজ থাকত ।ব্যটসম্যান এক এক বলে এক একটা কাগজ তুলত। আমরা এইটার একটা বিশ্বকাপ ও আয়োজন করেছিলাম। বিভিন্ন জন বিভিন্ন দেশের হয়ে। সেটাতে ফাইনালে উঠেছিল জিম্বাবুয়ে আর নিউজিল্যান্ড। চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল নিউজিল্যান্ড। সেই খেলার জন্য ক্লাস ৯ (তখনো আমাদের জুনিয়র আসেনি) বিচার দিয়েছিল প্রিফেক্ট দের কাছে। কিন্তু প্রিফেক্ট রা সেটাতে কোন দোষ খুঁজে পাননি। এবং সেই বিশ্বকাপের ফাইনাল অনুষ্ঠানে আমাদের প্রধান অতিথি ছিল আমাদের হাউস প্রিফেক্ট নিহাদ ভাই এবং ১২ এর আরো দুজন পছন্দের ভাইয়া। মুসা ভাই আর ফজলে ভাই। সেই অনুষ্ঠানে চানাচুর আরো কি কি ছিল সেই সাথে ছিল বর্ণাড্য সমাপনী অনুষ্ঠান। এক স্যার চলে এসেছিলেন এত হইচই শুনে। নিহাদ ভাই গিয়ে দাঁড়াতে আর কোন সমস্যাই হয়নি। ক্লাস ৯ এর ভাইয়ারা তখন হিংসায় জ্বলে যাচ্ছিল।

ক্যাডেট কলেজের ক্রিকেটের কথা কিভাবে ভুলি। ওখানেই আমি আমার জীবনের একমাত্র সেঞ্চুরী এবং একমাত্র হ্যাট্রিক করেছি। সেঞ্চুরী ক্যান্টিন ক্রিকেটে আর হ্যাট্রিক করিডোর ক্রিকেটে। আর ক্যান্টিন ক্রিকেটেই আমি আমার জীবনের একমাত্র টেস্ট ম্যাচ খেলেছি। ২০ ওভার করে একদিন ধার্য্য করা হয়েছি। ৫ দিন এর খেলা । কিন্তু শেষ হতে ৭-৮ দিন লেগে গিয়েছিল ডিউটি মাষ্টার দের অসহযোগিতায়। সেই জন্য পরে আর টেস্ট ম্যাচের আয়োজন করা হয়নি। ওহহ আমাদের এই পিচটা ছিল ক্যান্টিনের সামেন তাই এইটার নাম ছিল ক্যান্টিন ক্রিকেট। এসম্বন্ধে একটা ছোট্ট কাহিনী বলে শেষ করি। শোনা কাহিনী। তখন ১৬ ব্যাচ লিডিং (৯১ ইনটেক)এ। সোহরাব হোসেন তালুকদার আমাদের প্রিন্সিপ্যাল তার ঠেলায় এডজুট্যান্ট স্টাফ এক ঘাটে পানি খায়। তো হেভি জম্পেশ ক্যান্টিন ক্রিকেট চলছে। আনোয়ার ভাই তখন কলেজ প্রিফেক্ট মঞ্জুর ভাই তিতু্মীর হাউসের হাউস প্রিফেক্ট। দুজনই সোহরাব স্যার এর খুব প্রিয়। দুজনই খেলায় আছে। এমন সময় হাউসে প্রিন্সিপ্যালের আগমন এবনং কট বাই রেড হ্যান্ড। সবাই আর পালায়নাই কারন আনোয়ার আর মঞ্জুর যখন আছে তখন বেঁচে যাবে। আসলেই সবাই বেঁচে গিয়েছিল। প্রিন্সিপ্যালের ডায়লগ ” বুকের বাম পাশটা বড় ব্যাথা করে আনোয়ার”।

৮ টি মন্তব্য : “ক্রিকেট@ক্যাডেট কলেজ”

  1. এইটা আমাদের ব্যাচের ছবি না। আমার ক্লাস ১২ এর ছবি সব হারিয়ে গেছে। ক্যামেরার ফিল্ম নষ্ট ছিল। কি যে কষ্ট লাগছিল। এইটা সিনিয়র একটা ব্যাচের ছবি।

    জবাব দিন
  2. কুচ্ছিত হাঁসের ছানা

    কিরকেট? এইডা আবার কি? মাঠে আবার কেউ কিরকেট খ্যালে নাকি?
    কিরকেট তো খ্যালতে হয় রুমে , টিটি ব্যাট আর টিটি বল দিয়া...
    এইডা থিকাই তো পরে কিরকেট খ্যালা মাডে গ্যাল। 😀

    ধন্যবাদ।
    ঢিঁচ্চু...

    জবাব দিন
  3. কামরুল ভাই... আপনি কমনরুম ক্রিকেটের কথা বাদ দিছেন... অইটাও বহুত জনপ্রিয় ছিল =)

    আমরা ম্যাট্রিক এর প্রথম পরীক্ষা [English 1st paper] দিতে যাওয়ার এক ঘন্টা আগেও ক্যান্টিন এর সামনে ক্রিকেট খেলতেছিলাম... এই জিনিস শুধু ক্যাডেটদের পক্ষেই সম্ভব!

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।