শান্তর বাসা

মাঝখানের কিছু বছর আমাদের বন্ধুদের এমন একটা সময় গিয়েছিলো, যখন আমাদের সবার ২য় ঠিকানা ছিলো শান্তর বাসা।
শান্তর বাসার খোঁজ কখন কেমন করে যে পাই, এতদিন পরে আমার আর সেসব কিছু মনে নেই। কিন্তু পাবার পর থেকে এমন হতো যে, প্রায়শই আমরা, বন্ধুরা, নিজেদের সবাইকে আবিষ্কার করতাম শান্তর বাসায়। কারন সহ বা কারণ ছাড়াই। খিদে পেলে বা না পেলে। আড্ডা দিতে চাইলে বা না চাইলেও। বাবা-মা র সাথে অভিমান করে দিনের পর দিন শান্তর বাসায় কাটিয়েছে, এমন বন্ধুও আছে আমাদের!
ঐ বাসায় যাওয়ার শুরুটা সম্ভবত হয়েছিলো সুমী আপুর বিয়ের সময়। সুমী আপু আসলে আমাদের বোন। আসলে শান্তরও বোন। আরও ভালভাবে বললে বলি, সুমী আপু ছিলো শান্তরই বাবা-মার মেয়ে, কিন্তু যতটা সে শান্তর বোন, তারচেয়ে কোন অংশে কম বোন ছিলো না আমাদের। আমি অনেকদিন পর্যন্ত ভেবেছি, পৃথিবীতে এই একটা অসীম আশ্চর্য পরিবার।
শান্তর আম্মু, স্বভাবতই আমাদের আন্টি, আমাদের ডাকতেন শিয়ালের বাচ্চা। আমরা কেউ রাত বিরেতে অথবা সকালে অথবা, দিনের যে কোন সময় একেবারে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার ভঙ্গিতে সেই বাসায় হাজির হতাম, হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে লানচ অথবা ডিনার সেরে ফেলতাম। আন্টি বলতেন, শিয়ালের বাচ্চা, এতদিন পরে আসলি? যদিও, আমরা হয়তো ঠিক সপ্তাখানেক আগেই ওনার পোলাওয়ের হাড়ি শেষ করে গিয়েছিলাম।
শান্তর আরেক বোন সাথী আপু। মৌসুমী ভৌমিকের ঐ গল্প লেখার গানটা প্রথম শুনি সাথী আপুর কাছেই। শান্তর একটা সিডি প্লেয়ার ছিল তখন, আমার ছিলো না তখনো। আমি তখন শান্তর সিডি-ওয়াকম্যানটা কোলের উপরে রেখে গান বাজিয়ে শুনতাম, আর মনে মনে হিসেব করতাম, কত দাম এটার? এবার টিউশানীর টাকাটা পেলেই আমি কিনে ফেলবো ঠিক এরকমই একটা রূপালী যন্ত্র।
তো, শুনতে শুনতে ভাবতে ভাবতে একদিন মৌসুমী ভৌমিকের গানটাও শোনা হলো। আর আমরা সবাই আশ্চর্য হয়ে গেলাম। কি অদ্ভুত সুন্দর গান, কি আশ্চর্য তার কথা, তার সুর।

সুমী আপুর বিয়ের কথা এলেই, আমরা বন্ধুরা, যখন গল্প করি নিজেদের মধ্যে, তখন বেশ গর্ব করে বলি, ঠিক এইভাবে, আমরা যে বছর সুমী আপুর বিয়ে দিয়েছিলাম – -। কথাটা মিথ্যে নয় এক বিন্দুও। একটা প্রাপ্তবয়স্ক প্রশান্তি চলে আসে আমাদের সবার মুখে, চোখে, আর আমরা পান চিবুনোর মত আয়েশ আর তৃপ্তি নিয়ে ভাবি, আমরাই তো বিয়ে দিয়েছিলাম সুমী আপুর!
আমরা প্রায় ডজনখানেক ছেলে পেলে, আমরা যারা শান্তর বন্ধু ছিলাম, অথবা সুমী বা সাথী আপুর ভাই ছিলাম, আমরা সবাই টানা এক হপ্তা শান্তর বাসায় কাটিয়ে দিয়েছিলাম বিয়ের আয়োজনে। আমাদের কেউ ফুল কিনতে দৌড়েছিলো, কেউ ডেকোরেটর, কেউ কম্যুনিটি সেন্টারের বুকিং দিতে আংকেলকে সাথে নিয়ে ছুটেছিলো, কেউ বরের জন্যে উপহার কিনতে। সব আমরাই করেছিলাম।
আমার এখনো মাঝে মাঝে অবাক লাগে, সেই সময় বা সেই বছরগুলোর কথা ভাবতে। সত্যি সত্যিই মাঝে মাঝে, শিয়ালের বাচ্চার মতই ঘাড়ের রোঁয়া ফুলিয়ে বসে বসে সেইসব দিনের কথা ভাবি, শান্তর বাসার কথা ভাবি।

*
দেশের বাইরে প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেলো।
শান্তর বাসার আমরা, সেই বাচ্চা শিয়ালেরা নানান জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছি, নানান দেশে। শান্তও দেশে নেই এখন, ইংল্যান্ডে থাকে বউ নিয়ে।
গত হপ্তায় আমাদের বন্ধু চপল দেশ ছাড়া হলো। বাসা বদলের হ্যাপা সামলে আমি বেশ কদিন নেট-হীন ছিলাম। তাই কারও সাথে যোগাযোগ নেই। ইমেইল এমনকি এসএমএসও ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে এখন, লোকে আজকাল পাশের রুমে গেলেও ফেইসবুকে স্ট্যাটাস রেখে যায়, ঐ ঘরে যাই।
তো, সেই ফেইসবুকে কদিন না ঢোকায় আমি খবর পাইনি, চপল দেশ ছাড়া হয়ে ইতিমধ্যে লন্ডনও পৌছে গেছে। গিয়ে বরফ নিয়ে ক্যালাকেলি করে প্রোফাইলে সেই ছবিও ঝুলিয়ে দিয়েছে!
আমি দেখে বেজায় রাগ, কবে গেলি, জানালিও না। তো, হাবিজাবি কথা শেষ করে জিজ্ঞেস করি, উঠছিস কই? ডর্মে?
চপল অবাক হয়ে বললো, না, কই আবার, শান্তর বাসায়!

৩,৭৭৫ বার দেখা হয়েছে

৪৯ টি মন্তব্য : “শান্তর বাসা”

  1. সিরাজ (৯৪-০০)

    আমার জীবনের একটা বড় সময় কেটেছে শান্তর বাসায়...।এমন ভাবে যেতাম যাতে করে রাতের খাবার,সকালের আর একবারে দুপুর গরিয়ে বিকাল পার করে আসা যায়...।কারন পকেট তো ফাকা...। 🙁 🙁 🙁 🙁
    ঐ বাসা থেকে আবার রাতে চিড়িয়াখানার বাঘের ডাক শোনা যেত...রাইন খোলার ধালের সেই বাসা...।আমার মাঝে মাঝে মনে হ্য় মধুর কেন্টিনের মত এর কোনো একটা জটিল নাম দেয়া দরকার কারন আমাদের সকল সু কৃতি গুলোর মাস্টার প্লান ওখানেই হত...।

    তারেক আনেক আনেক :salute: :salute: :salute: এই লেখাটা এত সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলার জন্য...।

    জবাব দিন
  2. ১.
    একি!! আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি? তারেক লেখা দিছে , এটা তো বিশ্বাস হইতেছে না। 😮 ওই জুনা আমারে চিমটি দিয়া দেখতো !

    ২.
    মিছা কথা কস ক্যান? আন্টি শুধু তোরে শিয়ালের বাচ্চা ডাকতো। আমাদের তো আদর কইরা কামরুলবাবু, শোয়েববাবু, চপলবাবু, শান্তবাবু ডাকতো। :grr:
    ৩.
    সুমী আপুর বিয়েতে বরের গেট ধরার সময় রুমি ভাইয়ের সাঙ্গোপাঙ্গ দের সাথে আমার আর রনস এর ঝগড়া মনে আছে? গেটের টাকা নিয়ে দামাদামি? :gulti:
    ৪.
    থ্রি-পিস, টুপিস কাহিনীটা বললি না !! ;;;
    ৫.
    সুমী আপুর বিয়ের সময় রঙ ছিটাইয়া আমার তুই আমার একটা টি-শার্ট নষ্ট করছিলি। সুদে-আসলে ওইটা এখন শেরোয়ানী হইছে। সুতরাং আমার বিয়ার শেরোয়ানী তুই কিনে দিবি। :khekz:

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)
    সুদে-আসলে ওইটা এখন শেরোয়ানী হইছে। সুতরাং আমার বিয়ার শেরোয়ানী তুই কিনে দিবি।

    কামরুল ভাই, আপ্নে তো মিয়া কাজ আগায়া ফেললেন... :thumbup:
    আমরার কি হইব??? :((


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    আমাদেরও ছিল এমুন একখান বাসা, ......মানে বন্ধুর বাবার, কিন্তু আবার আমাদের ব্যাচের, মানে......ওই আর কি ~x( (ক্যামনে বুঝাই?)।

    নাহ! আরেকদিন কমুনে...

    আসলে এই লেখাটা কঠিন ভালো হইছে :thumbup: :gulli:


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  5. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    তারেক ভাই, আপ্নের কাছে গরীবের একটা অনুরোধ ছিল... ;;)
    আপনি যদি চিন্তা করে লেখা দেবার মতন সময় নাও পান, তবুও দুই একদিন পরপর যা মনে আসে লিখে দেবেন... :-B

    আমরা আপনার লেখা বড়ই মিস করি... :hug:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  6. আলম (৯৭--০৩)
    দিনের যে কোন সময় একেবারে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার ভঙ্গিতে সেই বাসায় হাজির হতাম, হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে লানচ অথবা ডিনার সেরে ফেলতাম। আন্টি বলতেন, শিয়ালের বাচ্চা, এতদিন পরে আসলি?

    :clap: ভাই কুমিল্লার ট্যাগ লাগান্‌ না ক্যান্‌?
    শুভ ড্রাইভিং।

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।