প্রবাসের ডায়েরি থেকে…(প্রথম খন্ড) – ২

প্রবাসের ডায়েরি থেকে…(প্রথম খন্ড) – ১

৪। আমি আর তৌহিদ বসে আছি বাংলাদেশ সেন্টারের টিভি রুমে । চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছি কি কি আছে। টিটু ভাইয়ের সাথে পরিচয় হলো টিভি রুমেই। কথায় কথার অনেক খোঁজ খবর নিলেন। আমাদের খাওয়া দাওয়ার দূর্দশার কথা শুনে বললেন, “কাল তো রবি বার, আমার তেমন কাজ নেই, চল তোমাদের কে বাজার করতে নিয়ে যাব। তারপর এসে একসাথে রান্না করে খাব, তোমাদেরও রান্না শেখা হলো”। ঐদিন রাতে আমরা ওনার সাথেই খেলাম। পরদিন সকালে টিটু ভাইয়ের সাথে বের হয়ে প্রথমে ৮ পাউন্ড দিয়ে এক সপ্তাহের একটা “বাস পাশ” কিনলাম। এই পাশ দিয়ে আগামী ৭ দিন লন্ডনের যে কোন বাসে যে কোন সময় ভ্রমন করা যাবে। ঘটনা জানার পর আমাদের চোখে মুখে আলোর ঝলকানি দেখা গেল। আমরা বাসে করে ইষ্ট লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রবিবার হওয়ার কারনে অক্সফোর্ড সার্কাস আর টটেনহাম কোর্ট রোডে ভীড় ভীড় ছিল, হোয়াইট চ্যাপেল পৌঁছাতে প্রায় ২ ঘন্টা লেগে গেল। টিটু ভাইয়ের সাথে গল্প করতে করতে সময়টা খারাপ লাগেনি। ব্রিকলেনের নাম আগেও শুনেছি কিন্তু এটাই প্রথম দর্শন। লন্ডনের মধ্যে ছোট্ট একটি বাংলাদেশ খুজে পেলাম। দোকান-পাটের নাম পর্যন্ত ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলায় লেখা, বলা যায় বাংলার পাশাপাশি ইংরেজীতে লেখা। একটা বাংলাদেশী সুপার স্টোর থেকে আমরা চাল, ডাল, সব ধরনের গুড়া মসলা, পেয়াজ, মরিচ, সবজি, ২/৩ টা মুরগি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র ৩ সপ্তাহ হিসাব করে কিনলাম। কয়েকটা প্লাস্টিকের কৌটাও (রান্না করা খাবার ফ্রিজে রাখার জন্য) কেনা হল। বাজার থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেল। আমরা রান্না শুরু করলাম। টিটু ভাইয়ের এর কাছ থেকে রান্নার অনেক কৌশল শিখলাম। শেফ হিসাবে জীবনে প্রথমবারের মত আত্মপ্রকাশ করলাম। ভাত, ডাল আর মুরগির মাংস রান্না করে ফেললাম। বিশ্বাসই করতে পারলাম না যে আমরা এত ভালো রান্না করতে পারি। এরপর থেকে নিয়মিত রান্না করে খেয়েছি। মাঝে মাঝে ঝামেলা মনে হলে “কে এফ সি” অথবা “ম্যাকডোনালসে” খেয়ে নিতাম। অন্য যে কোন রেস্টুরেন্টের তুলনায় “কে এফ সি” এবং “ম্যাকডোনালসে” অনেক সস্তায় পেট ভরানো যেতো।

৫। এক সপ্তাহের “বাস পাশ” আমাদের কাছে ম্যাজিকের মত মনে হলো। পরিকল্পনা করলাম এটার সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম ব্যবহার করবো এবং সাত দিনে লন্ডনের অলি গলি পর্যন্ত চিনে ফেলব। দেখা গেল ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমরা ১৬-১৭ ঘন্টায় বাইরে বাইরে থাকি। একটা বাসে উঠি আর সেই বাসের সব স্টপেজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নামি না। ৩-৪ দিনের মধ্যেই আমরা মোটামুটি লন্ডনে কিভাবে চলতে ফিরতে হয় শিখে গেলাম। শুধু বাদ থাকলো লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড রেল, “টিউব”। এক সপ্তাহের টিউব পাশ কিনলে টিউব ও বাস দুটোই কাভার করে। সুতরাং আমাদের পরবর্তি সপ্তাহের পরিকল্পনায় থাকলো টিউব পাশ। বাস ভ্রমনের একটা সুবিধা হচ্ছে সব কিছু দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। লন্ডনে যত্রতত্র হাজারও বিচিত্র ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় হচ্ছে চুম্বন দৃশ্য। রাস্তায়, পার্কে এমন কি বাসের মধ্যে আশেপাশের সকলকে উপেক্ষা করে তরুন তরুনীর আবেগময় এই অন্তরঙ্গ মুহুর্ত প্রথম প্রথম দেখতে বেশ লজ্জ্বাই লাগতো, কিন্তু এতো বেশি দেখতে হয়েছে যে দুই এক দিন যেতে না যেতেই চোখে সয়ে গেলো।
কর্মব্যস্ত মানুষের ছুটে চলা দেখতে বেশ ভালই লাগত। আমরা ছিলাম মুক্ত বিহঙ্গের মত। সময়ের কোন সীমাবদ্ধতা নেই, নেই কোন কাজের কিম্বা পড়াশুনার চিন্তা, নেই ঘরে ফেরার তাড়া। চোখে ঘুম নেই, শরীরে ক্লান্তি নেই, আছে শুধু নতুনকে জানার এবং চেনার উৎসাহ। তারুন্যের উদ্দাম শক্তি শেষ হতে চাই না।

৬। শাম্মী আপুর সাথে তৌহিদের পরিচয় ইন্টারনেটে। বেকন্সফিল্ডে প্রিকোর্স চলাকালে আমাদের অবসর সময়টুকু কাটতো ইন্টারনেট রুমে। কোন এক চ্যাট রুমে তৌহিদের সাথে পরিচয় হল শাম্মী আপুর। বাসার টিএন্ডটি নম্বরও পাওয়া গেল। পরিচয়ের প্রথম অংশটা এভাবেই।
শাম্মী আপুর সাথে কথা বলে ঠিক করা হয়েছে আমরা ১৯ ডিসেম্বর সরাসরি আপুর বাসায় যেয়ে দেখা করব। আপুর বাসা ল্যুটনস্টোনে। একটু বাইরের দিকে, খুব সম্ভবত জোন ৫ এর মধ্যে পড়ে। শাম্মী আপুকে নিয়ে আমি সারাদিন তৌহিদকে খোঁচাতাম কিন্তু আমার উৎসাহের কোন কমতি ছিল না। বাসের মধ্যে আমি বারবার তৌহিদকে বলছি, “শোন, আপু যদি সুবিধার না হয় তবে আমি কিন্তু নেই, দেখা করেই ফুট। আর যদি সুন্দর হয়, তবে ডিনার না করে কিন্তু ফিরবো না”। অনেক লম্বা জার্নি করে দুপুরের ঠিক পরপর পৌঁছালাম ল্যুটনস্টোন। পৌঁছে ফোনবুথ থেকে আপুকে ফোন করল তৌহিদ। ফোন ব্যস্ত। ১০ মিনিট পর আবার ফোন করল, “ব্যস্ত”। পরবর্তি প্রায় এক ঘন্টা একই অবস্থা। আমি তো তৌহিদকে বুলশীটের উপরে রেখেছি। আমরা দুজনেই বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেলাম। বিকাল প্রায় শেষের দিকে। সিদ্ধান্ত নিলাম এবারই শেষ চেষ্টা, না পেলে “উলটা ঘোর, দৌড়ে চল” হয়ে যাব। অনেকটা নাটকের মতই এবার আপুকে পাওয়া গেল,
ঃ হ্যালো……
ঃ আপু, আমি ফাহিদ (তৌহিদের ডাক নাম)। গত এক ঘন্টা ধরে চেষ্টা করছি।
ঃ ওহ !! ফাহিদ, আমি সরি, দেশে ফোন করেছিলাম। কিছুতেই ফোন রাখতে পারছিলাম না। তোমরা কোথায়??
ঃ আমরা ল্যুটনস্টোন বাস স্টপেজে।
ঃ ওখানে একটা সুপার স্টোর আছে, তোমরা সুপার স্টোরের সামনে দাঁড়াও, আমি আসছি।
সুপার স্টোর আর খুঁজে পাই না আমরা। আমরা উদ্ভ্রান্তের মত কিছুক্ষন ঘোরাঘুরি করলাম, কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, লাভ হলো না। আপু বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে, ফোন করেও লাভ নাই। অবশেষে হতাশ ও নিরুপায় হয়ে বাস স্টপেজে ফিরে এসে নিজেদের বোকামির জন্য অনুতপ্ত হলাম। মিষ্টি একটা কন্ঠ, “তুমি ফাহিদ আর …… তুমি মেহেদী, তাই না”? পিছনে ফিরে দেখলাম, মোটা ফ্রেমের চশমা পরে অনেকটা দুঃখিত হওয়ার ভঙ্গিতে মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এক মায়াবতী কন্যা। আমি নির্বাক, অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। দুপুর ও বিকালের সকল দূর্ভোগকে ছাপিয়ে কন্ঠে ধ্বনিত হলো “একেবারেই ঠিক, আপনি বুঝলেন কি করে”? তৌহিদকে কানে কানে বললাম, “আজ বেঁচে গেলি”।
শুধু ডিনার না, আমরা থেকেই গেলাম আপুর বাসায়। আমি, তৌহিদ, শাম্মী আপু আর রনি ভাই (আপুর ভাই)আড্ডা দিতে দিতে রাত পার করে দিলাম। শাম্মী আপুর সাথে আবার দেখা হল ৩ দিন পর নটিং হিল গেট টিউব স্টেশনে। ঐ দিন আমরা আপুর সাথে সারাদিন ঘুরেছি।

চলবে………

৩,৪০৭ বার দেখা হয়েছে

৫১ টি মন্তব্য : “প্রবাসের ডায়েরি থেকে…(প্রথম খন্ড) – ২”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    লন্ডনে যত্রতত্র হাজারও বিচিত্র ঘটনার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষনীয় হচ্ছে চুম্বন দৃশ্য
    ইয়ে মানে হাসান ভাই,আপনেরা অংশ নেন নাই এই বিচিত্র ঘটনায়? ;;; ;;;
    অফ টপিক- :frontroll: :frontroll:

    জবাব দিন
  2. অনেকটা দুঃখিত হওয়ার ভঙ্গিতে মুখে এক চিলতে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এক মায়াবতী কন্যা

    লেখাটা পড়তে শুরু করার পর থেকে এই জাতীয় একটা টার্ণিং এর জন্য অপেক্ষা করছিলাম...
    :clap: :clap:

    ভ্রমণ কাহিনী যদি সুন্দর উপস্থাপন হয়, তাহলে তা আমার খুব ভালো লাগে।
    হাসান ভাই, সুন্দর হইতেছে।আরো চাই
    :boss: :boss: :boss:

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    মেহেদি তো জব্বর, লেখছোস... দেশে ফিরে দাওয়াত দিস, তোর হাতের রান্না খেতে হবে 😀


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।