নারীবাদ ও এর অপব্যবহার – প্রথম পর্ব

বলা হয়, নারীবাদ শুধু নারীদেরই নয়, মানবজাতিরই মুক্তির উপায়।
কারন এই যে হাজার বছর ধরে চলতে থাকা পুরুষতন্ত্র – এটা শুধু নারীদের নিষ্পেষিত করেই ক্ষান্ত হয় নাই, পুরুষদেরও করেছে নিষ্ঠুর, স্বার্থান্ধ, অমানবিক।
আর তা শুধু নারীর বিরুদ্ধেই না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ঘটেছে গোটা মানবজাতীর বিরুদ্ধে।
ফেমিনিজম মুভমেন্ট তাই নারীর একার মুক্তির মুভমেন্ট নয়, নারী-পুরুষ সবারি মুক্তির মুভমেন্ট।
সমস্যা হলো, যেকোনো মুভমেন্টেই একটি সুবিধাবাদি পক্ষ সামনে এসে পড়ে।
তাৎক্ষনিক ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে তারা এমন সব কাজে জড়ান যা আন্দোলনকারীদেরকে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিতো করেই, মূল আন্দোলনটাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।
সম্প্রতি Melissa A. Fabello ও Aaminah Khan এক গবেষনাপত্রে এরকম দশ ধরনের “নারীবাদি পুরুষ” চিহ্নিত করেছেন যাদের ব্যাপারে সকল নারীর সতর্ক থাকা দরকার।
এই সতর্কতা শুধু নারীবাদের স্বার্থেই না, নারীদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থেও জরুরী।
আমি এই দশ ধরনের নারীবাদি-পুরুষদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সচেতনতা তৈরীতে ইচ্ছুক।
আজ প্রথম পর্বে এরকম দুই ধরনের নারীবাদি-পুরুষদের নিয়ে লিখছি। বাকি গুলিও নিয়েও আগামিতে লিখার ইচ্ছা রইল।

টাইপ ওয়ান : *** সেইসব নারীবাদি পুরুষের ব্যাপারে সতর্ক হোন, যারা আপনার যৌনতা নিয়ন্ত্রন করতে খড়গহস্ত ***
এরা কারা? এরা হলো তাঁরা:
১) যারা কথায় কথায় “নারীমুক্তি”, “বডি পজেটিভ” কিংবা “সেক্সুয়াল এজেন্সি” জাতিয় নারীবাদি কথাবার্তা আওড়ায় কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য থাকে নারীবাদের প্যাচে ফেলে আপনাকে যৌনতায় জড়াতে উদ্বুদ্ধ করা।
উদাহরন: “আরে তুমি নারীবাদি নাকি। খুবই ভাল। আমিও তো নারীবাদি। জানই তো, নারীর সবচেয়ে বড় মুক্তি হলো শারীরিক মুক্তি। তাইলে আর চিন্তা কি? আমরা আমরাই তো। লেটস ফিক্স-এ ডেইট, এই স্বাধীনতা উদজাপনের জন্য, তাই না? নাইলে কেমন নারীবাদি হৈলা, যদি নিজের ইচ্ছামত যৌন স্বাধীনতাই না ভোগ করলা???” ইত্যাদি
২) এরা এমন ভাবে “আমি নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসি” কথাটা বলে ও সেটার ব্যাখ্যা দেয়, যেটার অর্থ দাঁড়ায় “আমি ততক্ষন যৌন-স্বাধীনতায় বিশ্বাসি, যতক্ষন তাতে আমার স্বার্থরক্ষা হচ্ছে”।
উদাহরন: “হ্যাঁ, আমি নারীবাদি তাই নারীর সম্পর্কের স্বাধীনতায়, যৌন-স্বাধীনতায় বিশ্বাসি। তাই বলে আমার সাথে সম্পর্ক ভেঙ্গে অন্যের প্রতি আকৃষ্ট হবা, এইটা তো মানা যায় না। আমি ওর চেয়ে কম কিসে? ব্লা ব্লা ব্লা…”
৩) যারা আপনার না শুনতে রাজি না, আপনার সেক্স পজেটিভিটির কারনে বা মুক্তির অজুহাতে এমন কিছু করাতে উদ্বুদ্ধ করান বা করতে চাপ দেন, যা আপনি পছন্দ করেন না।
“তুমি না নারীবাদি ও সেক্স পজেটিভ? নতুন কিছু বললেই তাইলে এত না না করো কেন? কিরকম নারীবাদি হৈলা?”
৪) যারা মুখে বলে “না মানে না” কিন্তু “এখনো না বলা হয় নাই”-টা কে হ্যাঁ বলে গন্য করে। আবার পরে যখন তাদের অগ্রহনযোগ্য আচরন নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়ে, বলে, “জানোই তো, আমি সম্মতিবিহীন যৌনতার কতটা বিপক্ষে…” ইত্যাদি ইত্যাদি।
৫) যারা মুখে বলে “না মানে না” কিন্তু যেসব নারীরা সেক্স-পজেটিভ তাদের কোনো সাফারিং বা সমস্যা হলে সে ব্যাপারে কটূক্তি করে। বলে, “এখন বুঝো, নারীবাদী হৈছো, সেক্স পজেটিভ হৈছো – এখন ঠেলা সামলাও…”
৬) যারা নিজেকে উদার ও এন্টি-রেইপ হিসাবে বর্ননা করে কিন্তু এই মত দেয়, “ঐশরিয়া, যতবড় সেলিব্রিটিই হোক, এখন সে মা হয়ে গেছে। তাঁর কি আর এইসব পোষাক পড়া, এইসব প্রেমের দৃশ্যে অভিনয় করা উচিৎ?”
৭) যারা নিজেরা পর্ন দেখে আবার যৌনকর্মিদের উদ্দেশ্যে কটূক্তি করে।
৮) যারা নিজেদের “রিয়েল ম্যান” বলে ভাবে কারন তাঁরা নারীর প্রতি সদয়। আর যারা ততটা সদয় না, “ওরা তো রিয়েল ম্যান না…” এই ভেবেই তৃপ্ত থাকে।
৯) যারা আপনার ইচ্ছা ও পছন্দ মেলে ধরার সহায়ক পরিবেশ তৈরী করছেন না; অথবা এতবেশি সমতার কথা বলছেন – যা সুবিচারের মাত্রা অতিক্রম করছে; অথবা যারা চায়, আপনি নিজে থেকে বলুন যে বলার, কিন্তু তাঁরা কিছু জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছুক না (পাছে এমন কিছু চেয়ে বসেন, যা সাধ্যাতিত!!!)।

মনে রাখবেন, আপনার যৌনতা অথবা আপনার অযৌনতা একান্ত ভাবেই আপনার ইচ্ছাধীন।
অন্য কারো চাহিদা বা খেয়ালখুশি মত তা পরিচালিত করার কোনো দায় আপনার নাই……

টাইপ টু : *** সেইসব নারীবাদি পুরুষ সম্পর্কে সাবধান হন, যারা বিশ্বাস করে, আপনি কেমন দর্শনধারী হবেন তা ঠিক করে দেয়াটা তাদের অধিকার ***
তাদের ব্যাপারে সতর্ক হোন :
১) যারা বলে, আপনার নিজের ইচ্ছায় মনের খুশিতে ঠোঁট রাঙ্গানোটা নারীবাদের সাথে সাংঘর্সিক বরং তাদের সাথে মিলিত হওয়াটা হলো পুরুষতন্ত্রের প্রতি একটি আঘাতস্বরূপ।
২) যারা আপনার চোখের পাপড়িতে দেয়া মাসকারা নিয়ে অথবা পায়ে রেজার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বলে, “আমার জন্য তোমার এগুলো করার কোনো দরকার নাই।” অথচ আপনি যখন বলেন, এগুলো আপনি তার জন্য করছেন না – তখন সে তা অবজ্ঞা করে।
৩) যারা বলে: “মেইক আপ, শর্ট স্কার্ট অথবা হাইহীল ছাড়াও তো তোমাকে খুবই সুন্দর দেখায়” – যেন আপনি এগুলো নিজের খুশিতে নয়, তাকে খুশি করার জন্য পরেছেন।
৪) যারা আপনাকে পিতৃতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা মুক্ত হতে আপনার ন্যাচারাল বিউটির প্রতি ইঙ্গিত করে, আবার উজ্জ্বল রঙের বদলে ন্যাচারাল কালারের মেইক আপ বা আউটফিট বেছে নেয়ার উপদেশ দেয়
৫) যারা নিজেদের “বডি পজেটিভ” দেখাতে, স্বাভাবিক কায়াগনের সাতারেরসহ যেকোনো পোশাক পরিধানে উৎসাহ দেয় অথচ স্থুলকায়াধারীগনের সাতারেরসহ অন্যান্য বিভিন্ন পোষাক পরিধানে নিরুৎসাহ জানায়।
৬) যারা নিজেদেরকে সমসুযোগে বিশ্বাসি ও ইতিবাচক প্রেমিক হিসাবে প্রমানের জন্য প্রাক্তন প্রেমিকাদেরকে সময় সময় সামনে নিয়ে আসে।
৭) যারা মনে করে একটা নির্দিষ্ট ধরনের, যেমন, ফরসা রমনিদের সাথে তাদের সম্পর্ক স্থাপনেচ্ছাটা তাদের জন্য একটি গ্রহনযোগ্য পছন্দ। অথচ, আপনি যদি তার অবস্থাটার কারনে তার প্রতি আকর্ষন বোধ না করেন, তাতে সে আপনার প্রতি বীতস্রদ্ধ হয়।
৮) যারা জিজ্ঞাসা করে বসে, “কাকে খুশি করতে এত সাজগোজ করো, বলতো দেখি?” ব্যাপারটা এমন যে আপনি যেন নিজের খুশিতে সাজগোজ করতে পারেন না। আপনি যা করবেন, তা যেন অন্য কাউকে না কাউকে পটানোর জন্যই করতে হবে!!!

মনে রাখবেন, আপনি কি পরবেন, কি পরবেন না, কেমন সাজবেন অথবা আদৌ সাজবেন কিনা – এইসবই আপনার একান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার, একান্ত ভাললাগার ব্যাপার।
কাউকে খুশি করতে বা কারো মন যোগাতে যে আপনাকে এসব করতে হবে – এটা একদমই ঠিক না!!!

নারীবাদ ও এর অপব্যবহার – দ্বিতীয় পর্ব

৪,৫৯৮ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “নারীবাদ ও এর অপব্যবহার – প্রথম পর্ব”

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।