বিষন্নতা ও পিঠব্যাথা নিয়ে একটি অনুসন্ধান

গতবছর এমন একজনের সাথে আলাপ হচ্ছিলো একই সাথে যিনি বিষন্নতা ও পিঠব্যাথায় আক্তান্ত।
তা শুনে জানতে উদ্যোগী হলাম, বিষন্নতার কারনে এই পিঠব্যাথা নাকি পিঠব্যাথা থেকে ঐ বিষন্নতা?
তখন যা যা জেনেছিলাম, এই হলো তা:


পিঠব্যাথার যারা ভোগেন, তা থেকে তাদের মধ্যে বিষন্নতায় আক্রান্ত হবার কোনো কারন আছে কিনা, আর সেটা হলে কি করনিয়, দেখতে বসেছিলাম।
কিন্তু কেচো খুড়তে সাপ বেরিয়ে পড়লো।
জানলাম,পিঠ ব্যাথা থেকে যেমন বিষন্নতার সুত্রপাত হতে পারে, একইভাবে, বিষন্নতার থেকেও পিঠব্যাথার সুত্রপাত হয়ে থাকে!!
যে সকল রোগীর পিঠব্যাথা ও ডিপ্রেশন দুইটাই আছে, দেখা গেছে তাদের মধ্যে ৪২% এর ক্ষেত্রে বিষন্নতায় আক্রান্ত হবার পর পিঠব্যাথার সুত্রপাত হয়েছে। বাকি ৫৮% পিঠব্যাথায় আক্রান্ত হবার পর বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়েছেন।
এর অর্থ হলো, বিষন্নতার কারনে পিঠব্যাথায় আক্রান্ত হওয়াটা বিরল কোনো ঘটনা না।
আসুন আগে এ ব্যাপারে কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক:
১) সমীক্ষা বলছে, যারা বিষন্নতায় ভোগেন, তাদের মধ্যে পিঠ ব্যাথায় আক্রান্ত হবার হার অন্যদের চেয়ে চারগুন বেশি।
২) ঠিক কি কারনে বিষন্নতা থেকে পিঠব্যাথার সুত্রপাত হয় তা নির্দিষ্ট করে জানা না গেলেও ধারনা করা হয়, বিষন্নতাসহ অন্যান্য মানসিক সমস্যাজনিত শারিরীক ব্যাথা যে কারনে হয়, একই কারন এক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এর সাথে মস্তিষ্কের ক্যামিকাল চেঞ্জের সম্পর্ক আছে – এমনটাই মনে হয়।

প্রসঙ্গটা উত্থাপনের কারন হলো, যারা যুগপৎ ভাবে বিষন্নতা ও পিঠব্যাথ্যায় আক্রান্ত (সেটা যেভাবেই হোক – পিঠব্যাথার কারনে বিষন্নতা অথবা বিষন্নতার কারনে পিঠব্যাথা), তাদের জন্য, কেবলই পিঠব্যাথার চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ্য বা স্বাভাবিক হওয়া কঠিন। পিঠব্যাথার চিকিৎসা নেয়ার পাশাপাশি তাদের জন্য বিষন্নতার চিকিৎসা নেয়াটাও জরুরী।


অনেক ধরনের ক্রনিক পেইন থেকেই বিষন্নতার সুত্রপাত হতে পারে।
তবে পিঠব্যাথা, বিশেষ করে তা যখন তীব্রতা সম্পন্ন হয়, তা থেকে বিষন্নতা সৃষ্টির সম্ভবনা থাকে অনেক বেশি। কারনগুলি এইরকম:
১) পিঠব্যাথার কারনে দিনের পর দিন নিদ্রা ব্যাহত হয়। এ থেকে জেগে থাকা সময়টাতে ক্লান্তি (ফ্যাটিগ) ও বিরক্তিকর (ইরিটেবিলিটি) অভিজ্ঞতার সৃষ্টি হয়।
২) পিঠব্যাথাটা এমন এক সমস্যা যা যেকোনো নড়াচড়ায় ব্যাথা জানান দেয়। অথচ দিনের বেলা, অর্থাৎ কর্মজজ্ঞের সময়টাতে নড়াচড়া তো করতেই হয়। দেখা যায়, রোগী যেকোনো নড়াচড়ার সময়েই তা করছেন ধীরে ধীরে ও অতিরিক্ত সতর্কতার সাথে। এতে করে দিনে দিনে তাঁকে বেশি বেশি সময় ঘরে অন্যদের থেকে দূরে একাকী সময় কাটাতে হচ্ছে। এই অবস্থা তাঁর জন্য সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, একাকিত্ব ও বিনোদনহীন জীবন-যাপনে বাধ্য করে।
৩) অনেক ধরনের কাজ-কর্ম চালিয়ে যেতে সমস্যা হয় বলে কারো কারো উপার্যনেও এটা প্রভাব ফেলে। এ থেকে তখন পারিবারিক সমস্যা ও উৎকন্ঠার সুত্রপাতও হয়।
৪) ব্যাথা নিরাময়ে ব্যবহৃত এন্টিইনফ্লেমাটরি ঔষধের প্রভাবে আন্ত্রিক জটিলতা ও বাউল মুভমেন্টে সমস্যা হয়। এ ছাড়াও মানসিকভাবে উদ্যমহীন একটি বোধ দেখা দেয়।
৫) ব্যাথার কারনে স্মৃতিশক্তি ও মনযোগেও ব্যাঘাত ঘটে।
৬) ব্যাথার কারনে যৌনতা নেমে আসে নুন্যতম পর্যায়ে। এ থেকে যৌনজীবনে বড় রকমের ব্যাঘাত ঘটে এবং তা সম্পর্কের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।

পিঠব্যাথায় আক্রান্ত সকলেই তাই বিষন্নতায় আক্রান্ত হবার বড় রকমের ঝুকিতে থাকেন। এটা যেন না হয়, সেজন্য দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আসা জরুরী। আর হয়ে গেলে কেবল পিঠব্যাথাই নয়, বিষন্নতার চিকিতসাও পাশাপাশি নেয়া দরকার।
এটা বললাম, কারন যে, দেখা গেছে, যারা যুগপৎ ভাবে বিষন্নতা ও পিঠব্যাথ্যায় আক্রান্ত (সেটা যেভাবেই হোক – পিঠব্যাথার কারনে বিষন্নতা অথবা বিষন্নতার কারনে পিঠব্যাথা), তারা পিঠব্যাথার চিকিৎসা নেয়ায় যতটা মনযোগী, বিষন্নতার চিকিৎসা নেয়ায় ততটা না। অথচ উভয় চিকিৎসা না করা হলে সমস্যা থেকে উত্তরন সম্ভব হয় না।
তাছাড়াও সমীক্ষা থেকে জানা যায়, পিঠব্যাথা নিরাময়ে সার্জিকাল অপশন ব্যবহার করেও অনেক সময় ভাল ফল পাওয়া যায় না রোগীর বিষন্নতার কারনে।
রোগীর বিষন্নতা অস্ত্রপ্রচারের মাধ্যমে ঘটানো সংশোধনের সুফল কার্যকর হওয়ায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।


ইচ্ছা ছিল, এই কিস্তিতে কিছু রিস্ক ফ্যাক্টর ও কিছু প্রিভেন্টিভ মেজার নেবার কথা বলে শেষ করে দেবো লিখাটা।
কিন্তু সে সব খুজতে গিয়ে অদ্ভুত কিছু তথ্য পেলাম। তাই লিখাটার মোড় একটু অন্য দিকে ঘোরাতেই হলো!!!
জানলাম, পিঠব্যাথার পিছনে যে কারন গুলো সবচেয়ে বেশি দায়ি, তা হলো হাড়ে ক্যালশিয়ামের অভাব ও ডিজেনারেশন জনিত আসম-ক্ষয়পুরন।
তো, বেশি বেশি ক্যালশিয়ামযুক্ত খাবার খেলেই তো এই সমস্যার সমাধান হয়।
না হয় না।
কারন হাড়ে ক্যালশিয়াম পৌছুতে হলে শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি থাকতে হয়।
অনেকেরই নাকি সেটা থাকে না। আর তাই যত ক্যালশিয়ামই খাক না কেন, তা হাড় অবদি পৌছায় না।
এরপর তাই ভিটামিন ডি কম থাকে কেন, জানতে আগ্রহি হলাম।
জানলাম, যদিও এই ভিটামিন ডি খেতে হয় না, সূর্যালোক ত্বকের সংস্পর্শে এলে এটা শরীরে নিজে নিজেই তৈরী হয়, তবুও অনেক রোদ্দুরের দেশ: অস্ট্রেলিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় এই ভিটামিন ডিয়াল্পতার সমস্যা বেশ প্রকট।
বিশেষ করে নারীদের মধ্যে।
তা কেন? তা কেন??
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় এটার পিছনে মূলতঃ যে কারন দায়ী তা হলো সংস্কৃতিগত কারনে পোষাক আশাকে তাদের আদ্যপান্ত ঢেকে থাকার প্রবনতা।
অস্ট্রেলিয়ায় তো এটা নাই। ওরা তো কত খোলামেলা, তাইলে ওখানে এই ভিটামিন ডি সংকট কেন?
ওখানকার মানুষ যে বড় বেশি স্থুলতা সম্পন্ন, তাই।
হ্যা বেশি ঢেকে ঢুকে থাকারা ছাড়াও যারা স্থুলতা সম্পন্ন অর্থাৎ বিএমআই ৩০ বা তাঁর উর্ধে, তাদের মধ্যে ভিটামিন ডি-স্বল্পতার হার অতি উচ্চ।
জানতে ইচ্ছা হলো, স্থুলতার সাথে ভিটামিন ডিস্বল্পতার সম্পর্কটা কি?
আছে সম্পর্ক।
গভীর সম্পর্ক আছে। জানাচ্ছি একটু পরেই………


সাউথ এশিয়োদের দেহে নাকি কি একটা মন্দ জিন আছে। সেই জিনের কারনে, আমরা যে দেহ গড়নটা পাই, তাকে “সেন্টার হেভী” বলে।
তো সমস্যা কি, এতে?
সমস্যা একটা আছে। আর তা হলো, এই দেহ গড়নের জন্য বাকি বিশ্বের চেয়েও কম বিএমআই-তেই আমরা স্থুলতা প্রাপ্ত হই।
অন্যত্র যেখানে স্বাভাবিক বিএমআই ২০-২৫, আমাদের জন্য সেটা ১৯-২৩।
তারমানে, অন্যত্র যেখানে ৩০ বা তার উর্ধে বিএমআই হলে একজনকে স্থুলতা সম্পন্ন গন্য করা হয়, এ অঞ্চলে সেটা ২৮। কপাল! কপাল!!
যা বলছিলাম, এই স্থুলতার সাথে ভিটামিন ডি-এর স্বল্পতার সম্পর্ক কি?
স্থুলতা থাকার অর্থ হলো দেহে ফ্যাটের আধিক্য থাকা।
এই ফ্যাট জমা হয় এডিপোস টিস্যুতে।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে ফ্যাট একাই জমা হয় না, তা শরীরে থাকা ভিটামিন ডি টেনে নিয়ে এডিপোস টিস্যুর মধ্যে গিয়ে জমা হয়।
এই কারনেই, স্থুলতায় আক্রান্তগনের রক্তে ভিটামিন ডি-এর সংকট হয়।
শুধু যে ভিটামিন ডি-এর অভাব তাদের হাড়ে ক্যালশিয়ামের শোষন কমিয়ে তা দুর্বল করে ফেলে, তা না। দেহের ওজন হেতু দেহের ওজনবাহি হাড়ের ওপর বাড়তি চাপ ফেলে সেগুলোর বারোটা বাজিয়ে দেয়। আর এতে সবচেয়ে ভুক্ত ভোগি হলো লাম্বার নামক লো-ব্যাকের পাচ খানা হাড়।
এই অবস্থা থেকে পিঠব্যাথা ও হাড়ের ভঙ্গুরতায় আক্রান্ত হয়ে অকাল বার্ধক্য চেপে ধরতে খুব একটা তাই সময় লাগে না।
তাইলে কি করনিয়?
১) স্বাভাবিক ওজন (বিএমআই ১৯-২৩ এর মধ্যে) বজায় রাখতে চেষ্টা করা।
২) যদি স্থুলতায় আক্রান্ত হন (বিএমআই ২৮ বা তাঁর উর্ধে), শরীরের ভিটামিন ডি-এর মাত্রা পরীক্ষা করার জন্য চিকিতসকের পরামর্শ নেয়া। যদি আপনি ভিটামিন ডিস্বল্পতা বা হাইপো ভিটামিনোসিস ডি-তে আক্রান্ত থাকেন – তাহলে চিকিৎসা নিন।
৩) সংস্কৃতিগত কারনে যদি বেশি ঢেকেঢুকে থাকতেই হয়, থাকুন, কিন্তু কিছুটা সময় বের করে, কোনো না কোনো ভাবে শরীরের যথা সম্ভব বেশি অংশে রোদ লাগানোর একটা ব্যবস্থা করুন। অবশ্য একটানা না, বিরতি দিয়ে দিয়ে।

মনে রাখবেন, শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি থাকলে, স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহনেই হাড়ের উপযুক্ত পুষ্টি হবে। এতে করে ডিজেনারেশন জনিত অস্টিওয়ার্থারাইটিস থেকে দীর্ঘদিন দূরে থাকতে পারবেন। তবে এজন্য আপনাকে যা করতে হবে, তা হলো,
১) স্থুলতা কমানো
২) শরীরে রোদ লাগতে দেয়া।


দেখুন কোথা থেকে শুরু করে কোথায় চলে এলাম।
ধরুন, আপনার হয়েছে পিঠব্যাথা। কিন্তু সেটা যদি বিষন্নতার কারনে হয়ে থাকে, তাহলে, বিষন্নতার চিকিৎসা না করে কিন্তু পিঠব্যাথা থেকে মুক্ত হতে পারবেন না।
আবার ধরুন, আপনার হয়েছে বিষন্নতা, কিন্তু সেটার কারন যদি পিঠব্যাথা হয়, তবে সেটার চিকিৎসা না করে বিষন্নতা কিন্তু দূর হবে না।
আবার সেই পিঠব্যাথা যদি হাইপো ভিটামিনোসিস ডি-এ আক্রান্ত হবার জন্য হয়, তাহলে সেটারও চিকিৎসা করা লাগবে।
আবার হাইপো ভিটামিনোসিস ডি-তে আক্রান্ত হওয়াটা যদি ওবেসিটির কারনে হয়, সেটা থেকে মুক্তি না মিললে কোনো কিছুই ঠিক হবে না।

শেষ কথা, ওবেসিটি বা স্থুলতা থেকে মুক্ত থাকুন!!!

৫,৬৫৪ বার দেখা হয়েছে

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।