গোধু্লি কথন – ৩

গোধু্লি কথন – ১
গোধু্লি কথন – ২

২৯/৩/২০০৪,

এ’কদিন কলম ধরতে একটুও ইচ্ছে করেনি। আসলে ডাইরী লেখাটা আমার ধাতে নেই। অনেকে কিভাবে যে রুটিন মেনে প্রতিদিনের দিনলিপি টুকে রাখে এটা আজো আমার বোধগম্য হয়নি, হবেও না। সম্ভবত আমি বেশ অগোছালো ধরনের।

শুনেছি মারা যাবা আগে মানুষের মাঝে নাকি অদ্ভুত সব ভাবনা কাজ করে, জীবনের প্রতি তীব্র হতাশাবোধ তৈরি হয়। সারাবেলা বসে বসে জীবনের পাওয়া-না পাওয়ার হিসেব মিলায়। আজকাল আমার অনুর্বর মস্তিষ্কেও নানা রকম চিন্তা আসছে। তবে কোনটাই চাওয়া-পাওয়া কিংবা হতাশার নয়; একটু অদ্ভুতূড়ে। এই যেমন, ভাবছিলাম একটা উইল বানাবো। যদিও আমার সম্পত্তির তালিকা বেশ ছোট, আর হৈমন্তীর মতো কোন সম্পদও আমার নেই। ডেল’এর একটা ল্যাপটপ, ক্যাননের ৫০ডি এস,এল,আর ক্যামেরাটা, একটা ছবির খাতা আর এই ডাইরী; বাকি যা আছে ওগুলো হাতে গোনার নয়। না একেবারে কমও না; এগুলোই কাউকে দিয়ে দেব। ঘরে পড়ে থাকলে মা’কে ওগুলো কাঁদাবে। ভাবছি ল্যাপিটা তমালকেই দেব, একটু লো-কনফিগারেশন বলে তমাল যদিও ওটাকে মুড়ির টিন বলে; তবে ওটা পেলে যে অখুশীও হবে না। ক্যামেরাটা রানাকে, আর ছবির খাতাটা তপোতীকে দেব, জানি আমি চলে গেলে ওটা ওর কাঁদবার খোরাক জোগাবে। আসলে পাগলীটা কাঁদতে ভালোবাসে, আর আমি, ওকে কাঁদাতে। ডাইরীটা কাউকে দেয়া যাবে না, পড়ে সবাই হাসবে। বেশ মনে আছে আমার, দেয়ালিকার জন্য সেবার একটা কবিতা লিখেছিলাম, খুব সিরিয়াস ধরনের প্রেমের কবিতা। উজবুক তমালটার সে কী ফিঁচলে হাসি; ওটা নাকি ফানি ছিল; হবে হয়তো।

রানার কাছে কিছু বই চেয়েছিলাম, সময় কাটানো দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতকাল এক গাদা বই নিয়ে রানা অনেকটা হুড়মুড় করেই রুমে ঢুকেই বলছিল, “আন্টির কাছে শুনলাম তুই নাকি রুম থেকে বের হস না। সন্ন্যাসে পেয়েছে নাকি দোস্ত?”
“ধুর ব্যাটা! রুমের ভেতরের সংসারটা খারাপ লাগছে না, ক’দিন বাদে তো রুমের সাইজও ছোট হয়ে যাবে।”
আমার সস্তা রসিকতায় কান না দিয়ে রানা বলছিল, “তোর সবগুলো বই পাওয়া যায়নি; পুরো নীলক্ষেত আর বাংলাবাজার চষেও অ্যাগির বইটা পাইনি। আর ন্যাবোকোভ না রবোকপ- ঐ রাশান বুড়োর বইটাও মেলেনি।”
পেইল ফায়ারটা পেলে ভালো হতো। তবে এমনিতেই যতগুলো এনেছিস, পড়ে শেষ করবার মতো সময় বোধহয় হয়ে উঠবে না।” কেমন যেন শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল রানা। তারপর অস্ফুট স্বরে বললো, “দোস্ত, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?” সায় পেয়ে মজার একটা প্রশ্ন করেছিল, অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। “দোস্ত, তোর কি আরো কিছু দিন বাঁচতে ইচ্ছে করে? নিজের চারপাশের পৃ্থিবীটাকে আরেকটু বেশি দেখতে ইচ্ছে করে না?”
“আমার আকাঙ্খার তালিকাটা খুব ছোটরে। কেন জানি অনেক আগে থেকেই বেঁচে থাকাটা উপভোগ করতে পারতাম না। হয়তো উপরওয়ালা আমার এত বিরক্তিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন।”
“তোর কথাগুলো কেমন হতাশামাখা মনে হচ্ছে।”

তীব্র স্বরে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। আমি হতাশ নই, আসলে তোদের কাছে হয়তো ওরকম লাগছে, কিন্তু আমি জানি আমি কোন রকম ডিপ্রেশন কিংবা আত্মিক মন্দায় কোন কালে ভুগিনি, এখনো ভুগছি না। তবে এটাও সত্য যে, বেচে থাকবার জন্য তেমন কোন স্পৃহাও এখন কাজ করে না। ইনফ্যাক্ট, কেন যেন নিজের পার্থিব প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে, বেঁচে থাকার প্রচলিত সংজ্ঞাটাই বদলে গিয়েছে। আচ্ছা, নিজের কথাগুলিই নিজের কাছে কেমন যেন বিতর্কিত লাগছে। আমি কি আসলেই অপ্রকৃ্তিস্থ হয়ে পড়ছি।

একটু অবাক হয়েছিলাম। রানা ফট করে রুম থেকে বের হয়ে যাবার জন্য নয়, বরং প্রায় সাথে সাথেই দরজা ঠেলে তপোতীকে ঢুকতে দেখে। একটু বিস্মিত কন্ঠেই জানতে চেয়েছিলাম, “কী রে! তোরা কি একজন একজন করে ইন্টারভিউ দিতে ঢুকছিস নাকি? কতক্ষণ হলো এসেছিস?”
“এইতো একটু আগে, ওপাশ থেকে তোদের কথা শুনছিলাম।”- মিষ্টি একটা টোল-পড়া হাসি দিয়ে জবাব দিয়েছিল পাগলীটা। -“কেমন আছিস এখন?”
“এইতো যেমন দেখতে পাচ্ছিস। ক্লাশ কেমন চলছে?”
“ক্লাশে যেতে ভালো লাগে না, আজকাল আমিও তোর মতো বাসা থেকে বের হই্না।”
“বাসা থেকে !!! আমি তো আমার রুম থেকেই বের হইনারে। স্বেচ্ছা নির্বাসন বলতে পারিস। ও শোন, একটা কথা অনেকদিন যাবৎ বলবো বলবো করেও বলা হচ্ছে না, আর আজ যদি না বলি, তবে কোনদিনই হয়তো তোর জানা হবে না।” “কি কথা, মহাশয়?”- একটু কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চেয়েছিল। নাটকীয়তা করে জানিয়েছিলাম ফিরে যাবার সময় বলবো।

তারপর প্রসংগ পালটে একথা-সেকথায় জানতে চেয়েছিল পহেলা বৈশাখে ওদের সাথে খানিকক্ষণ থাকতে পারবো কিনা; বোধহয় অনুরোধ ছিল, অথবা অনুকম্পা। হেসে দূর্বল শরীরের অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছি। সত্যি বলতে, যে কারো সঙ্গই আমার আজকাল বিরক্তির উদ্রেক করে। সাতরঙ্গা পৃথিবীর আলোর ছোঁয়া আমার কাছে নিষ্প্রয়োজন অনুভূত হয়, হাসি আর আনন্দের আহবান যেন পরিহাস।

পাগলীটা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “এভাবে একা একা থাকার মানে কী? কি সুখ পাচ্ছিস বল দেখি?” স্বভাবসিদ্ধ হাসির সাথে বললাম, “Practice makes a man perfect. ক’দিন পর তো চাইলেও তোরা সাথে থাকতে পারবি না, তাই আগেই একটু রিহ্যার্সেল সেরে নিচ্ছি। বলি অন্ধকারের ভূতগুলোর সাথে পাল্লা দিতে হবে না।” “তুই বড় অলক্ষুণে কথা বলিস।” “আমি মানুষটাই যে অলক্ষুণে, না হলে শেষ প্রহরেও কি তোদের সবাইকে এত জ্বালাতাম?” পাগলীটার চোখ দে্খি আবার ছলছল করছিল, ভাগ্যিস কেঁদে ফেলেনি, অবশ্য কাঁদলে হয়তো ভালোই লাগতো।

যাবার সময় বললাম, “তোকে একটা জিনিস দেবো, নিবি তো ?” হাত তুলে টেবিলের উপর পড়ে থাকা ছবির খাতাটা দেখাতেই ও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। তারপর বললো, “একদিন তোর একটা ছবি নিতে চেয়েছিলাম বলে বলেছিলি, তুই কারো জন্য ছবি আঁকিস না, শুধু নিজের জন্যই। আর আজ পুরো খাতাটাই……” কোন কিছু না বলে চুপ করে ওর চোখের পানি দেখছিলাম, আসলেই পাগলী !! চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই বললাম, “শুনবি না, আমার না বলা কথা।” ও ফিরে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই বললাম, “যখন কাঁদিস, তোকে অসম্ভব মায়াবতী লাগে, গল্প থেকে উঠে আসা অপ্সরীর মতো। অনেক চেষ্টা করেছি ঐ ভেজা চোখের অবয়ব আঁকতে, কিন্তু স্কেচে কখনো তুলে আনতে পারিনি।” কথা শেষ করার আগেই উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেরিয়ে গিয়েছে। আচ্ছা, অপ্সরীরা কি কাঁদে??

আজ মাথাটা খুব ভার ভার লাগছে, সম্ভবত নতুন ঔষুধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া। শুনলাম ডাক্তার আঙ্কেল গতকাল বাবাকে বলছিলেন, হয়তো মাসখানিকের মধ্যেই আমি স্মৃতি হারাতে শুরু করবো। ব্যাপারটা কেমন হবে? ছোটবেলায় যেভাবে খাতার ভুল উত্তরগুলো একটা একটা করে মুছে ফেলতাম, সেভাবে সবস্মৃতি একটা-দুটো করে হারিয়ে যাবে। ভাবছি মেমোরী সেলের ব্যাপার-স্যাপারগুলো নিয়ে নেটে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করবো, প্রসেসটা নিশ্চই বেশ ইন্টারেষ্টিং হবে।

মরে গেলে বোধহয় মা অনেক করে কাঁদবেন, বাবা হয়তো থেকে থেকে চোখের ময়লা মোছার ভান করবেন। বন্ধুশোকে হয়তো তপোতী্রও মন খারাপ হবে, ও কি খুব বেশি কাঁদবে? যাক শেষবেলাতেও তাহলে ওকে আরো একবার কাঁদা্তে পারবো। রানা চুপ করে ঘরের কোণে বসে থাকবে। অবশ্য এমনটাই যে হতে হবে তা বলছি না, কিন্তু এখন এটাই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে।

তারপর, তারপর হয়তো সবার মনের কোঠাবাড়িতে ঝুলে থাকা আমার অস্পষ্ট ছবিগুলোতে ধুলো জমবে। অল্প অল্প করে ধুলোর আস্তরণ পুরু হবে। একদিন সহসাই আমার নির্জীব প্রাচীন সত্ত্বাটা জমে থাকা স্মৃতির ধুলোর ভারে টুপ করে তলিয়ে যাবে। বছরে একবার বাড়ির সবার মন খারাপ হয়ে পড়বে, তপোতী হয়তো অগোছালো ঘরের জঞ্জাল সরাতে গিয়ে ভুল করে খাতাটা তুলে নেবে; ক্যামেরার আই-পীসে চোখ রেখে ক্ষণিকের জন্য হয়তো রানার স্মরণে ধূলো-ঢাকা আমি নিষ্ফল চেঁচিয়ে উঠবো। তারপর আবার সময়ের তোড়ে ভেসে যাবো। আমার কি মন খারাপ করা উচিৎ? জানি না, আসলে নিয়তির পাল্লায় আমার মন ভালো-খারাপের কোন ভর নেই।

অনেকদিন স্বপ্ন দেখিনি, আজ একটা দেখলে মন্দ হতো না। শুনেছি, স্বপ্ন নাকি রঙ্গিন হয়, আমারগুলো তো ধূসর; অনেকটা পেন্সিলে আঁকা স্কেচগুলোর মতো। লেখাগুলো কেমন ঝাপসা লাগছে, শরীর বোধহয় আর টানতে চাচ্ছে না; আজকাল আর ওভারটাইম ধাতে সয় না। শুয়ে পড়বো আজ, হয়তো স্বপ্ন দেখা হবে না, তবে বিধাতা চাইলে সকালের তরুণ সূর্যের ছোয়াটা হয়তো চোখেমুখে জড়িয়ে নেব।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পড়তে গিয়ে কেমন নেশা ধরে গেছে, নিজেকে যেন কথনের জায়গায় কল্পনা করছিলাম। খুব জানতে ইচ্ছে করছে ওকে, খুব কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে; যাক গে সব ইচ্ছেই তো পূরণ হবার নয়। আমারো শুয়ে পড়া দরকার, সারাদিনে যথেষ্ট ধকল গিয়েছে। বাকিটা বরং কাল পড়বো। হঠাৎ করেই একটা গান শুনতে খুব ইচ্ছে করছে, শুনবেন নাকি?

(চালাতে বড় কষ্ট হচ্ছে :bash: , চলবে :(( !?! )

Jakhon porbe na mo…
৩,৩১১ বার দেখা হয়েছে

৪০ টি মন্তব্য : “গোধু্লি কথন – ৩”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    রকিব,

    তুই সাহিত্যে এত বস জানলে তোরে দিয়াই ম্যাগাজিনের যাবতীয় প্রতিবেদন গুলা লিখাইতাম রে...

    মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে এমন একটা ছেলের অনুভূতি এইভাবে তুলে ধরা খুব কঠিন কাজ, অন্তত আমার কাছে।

    প্রাউড টু বি ইয়োর সিনিয়র, ম্যান!

    জবাব দিন
    • রকিব (০১-০৭)

      :shy: :shy: কলেজে থাকতে জীবনে কুনু গল্প, কবিতা লেখিনাই, প্যারোডি ছাড়া। বলেন কয় কাপ খাবেন ভাই :teacup: :teacup:
      আর ঘরোয়াতে বলে আসছি, কালকে লাঞ্চে ভুনা খিচুড়ি পাঠায় দিবে 😀


      আমি তবু বলি:
      এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

      জবাব দিন
  2. রকিব রে

    তোর লিখা এত্ত ভালো আর হৃদয়স্পর্শী যে আমি অবাক হয়ে যাই এত্ত সুন্দর কীভাবে লিখতে পারে আমাদেরই মত কেউ !! :dreamy:

    চালিয়ে যা... কষ্ট হলেও সময় নিয়ে গোধুলী কথন শেষ কর।
    অল্প দু'তিন টা পর্ব আরো করে ফিনিশিং টা ভালো দিলে পাঠককূল আনন্দ পাবে।।

    তোর অসাধারণ এই লেখার জন্য তোকে আমার পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সম্মান---

    :salute:

    জবাব দিন

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।