তান্ত্রিকের ছোবল

১.
বাড়িটা দোতলা, একটু পুরান ধাঁচের। শ্যাওলা জমে সাদা রঙের দেয়ালে সবুজ সবুজ ছোপ পড়েছে। উঁচু দেয়াল পুরো বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে। জায়গাটা একটু নির্জন, শহরের বাহিরে। এজন্য সবুজের ঘাটতি এখনও দেখা দেয়নি এখানে।
‘আমার নাম আদনান।’ গেটের দারোয়ানকে নিজের পরিচয় দিল ও। ‘আমাকে আজকে আসতে বলা হয়েছিল।’
‘বড় সাহেব আপনার কথা বলেছে আমাকে। ভেতরে যান।’
দারোয়ানকে কিছুটা ভয়ার্ত মনে হল আদনানের। মনে মনে হাসল ও। দারোয়ানও তাহলে আমার পরিচয় জানে, ভাবল। সেক্ষেত্রে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। বাইক নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল আদনান। বাইকটা পার্ক করে ও বাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল।
কলিংবেল চাপার দুই মিনিট পর সদর দরজা খুলে গেল। এক মাঝ বয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে।
‘আমি আদনান সাদাত।’
‘ও, আসুন। ভেতরে আসুন।’
মহিলা আদনান ভেতরে ঢুকার জন্য জায়গা করে দিলেন। এরপর ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল ড্রয়িং রুমে।
‘আপনি বসুন। আমার স্বামীকে খবর দিচ্ছি আমি।’
মহিলা চলে গেলে আদনান চারপাশে চোখ বুলানোর সুযোগ পেল। বাইরে থেকে বাড়িটা দেখতে খুব পুরানো মনে হলেও ভেতরের আভিজাত্য দেখে সেটা ভুলে যেতে হবে। দামি সোফার নরম গদিতে বসে আদনান খানিকটা দেবে গেল। দেয়ালে অনেকগুলো পেইন্টিং ঝুলান। দেখেই বোঝা যায় অনেক দামি। আশেপাশের পরিবেশের তুলনায় আদনানের নিজেকে খুব বেমানান লাগল।
পাঞ্জাবী পরিহিত একজন রুমে এসে ঢুকলেন। ভদ্রতার খাতিরে আদনান দাঁড়িয়ে গেল।
‘বসুন বসুন।’
আদনানের মুখোমুখি একটা সোফাতে বসে পড়ল ভদ্রলোক। তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল আদনান। ভদ্রলোকের কপালের দুপাশের চুলে পাক ধরেছে। তবে বয়স খুব বেশি নয়, পঞ্চাশ হবে হয়তো। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ, এতে বয়স যেন বেড়ে গেছে আরও দশ বছর।
‘আপনি তো জানেনই আপনাকে কেন ডেকেছি।’
‘খুব বেশি কিছু না।’ আদনান জবাব দিল। ‘ফোনে আমাকে জানান হয়েছে আপনার ছেলের উপর
কিছু ভর করেছে।’
‘হ্যাঁ।’ ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ‘আমার একমাত্র ছেলে রাকিব গত পাঁচ দিন ধরে পাগলের মত আচরণ করছে। ডাক্তার, সাইকিয়াট্রিস্ট-সবই দেখান হয়েছে। এমনকি ইমাম, কবিরাজ ডেকে ঝাড়ফুঁকও করানো হয়েছ। কিন্তু কোন লাভ
হয়নি। হঠাৎ ছেলেটা কেন বিগড়ে গেল সেটা কেউ ধরতে পারছে না। শেষমেশ এক আত্মীয়ের মুখে আপনার কথা শুনি। এমনিতে জাদুতে কোন বিশ্বাস নেই আমার। কিন্তু সব ধরণের চেষ্টাই করে দেখছি। এখন আপনিই আমাদের শেষ ভরসা।’
ফোঁপানোর শব্দ শুনতে পেল আদনান। মহিলা সম্ভবত কাছে কোথাও দাঁড়িয়ে সবকিছু
শুনছিলেন।
‘মি.রহমান, আমি আপনার ছেলেকে সুস্থ করার সব ধরণের চেষ্টাই করব। কিন্তু তার আগে আমার কিছু তথ্য জানা প্রয়োজন।’
‘বলুন কী জানতে চান।’
‘এই বাড়িতে কত জন মানুষ থাকে?’
‘কাজের লোক আর দারোয়ানসহ ছয় জন। আমি, আমার স্ত্রী, রাকিব আর আমার ছোট
ভাই মিরাজ।’
আদনান খেয়াল করল, নিজের ছোট ভাইয়ের নাম বলার সময় রহমান সাহেবের ভ্রু কিছুটা কুঁচকে
গেল।
‘সবাই কি বাসায় আছেন?’
‘মিরাজ বাহিরে কোথাও টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে হয়তো। আমি ফোন করে ওকে চলে আসতে বলছি।’
‘ঠিক আছে। আমাকে রাকিবের রুমের নিয়ে চলুন।’
২.
আদনান ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। রাকিবের বাবা সোহাগ রহমানও ভেতরে আসতে
চেয়েছিলেন। কিন্তু আদনান নিষেধ করেছে। ঘরটাতেই ঢুকতেই আদনানের শীত শীত করতে লাগল। অথচ বাইরে তেজোদৃপ্ত সূর্য আগুন ছড়িয়ে যাচ্ছে।
আদনান রাকিবের দিকে দৃষ্টি দিল। ছেলেটার বয়স, বাইশ-তেইশের বেশি হবে না। খাটের উপর নেতিয়ে পড়ে আছে, চোখ বন্ধ। হাতপা খাটের সাথে বাঁধা। চোখ দুটো কোটরে বসে গিয়েছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে বলেও মনে হলো আদনানের।
ও খাটের কাছে যেতেই রাকিবের চোখ দুটো আচমকা খুলে গেল। শীতল চাহনিতে আদনানের দিকে তাকিয়ে আছে ও। আদনানের গা শিরশির করে উঠল। মানুষ, ভূত-প্রেত, জীন আর অন্যান্য অতিপ্রাকৃত জিনিসগুলো-সবাই নির্দিষ্ট ধরণের
শক্তি বিকিরণ করে। তবে একেক শ্রেণির শক্তি বিকিরণের মাত্রা একেক রকম, সেখানে নিজস্বতার ছাপ থাকে স্পষ্ট। সাধারণ মানুষ সেই বিকীর্ণ শক্তি নির্ণয় করতে পারে না বিধায় অতিপ্রাকৃত বিষয়গুলো এখনও কল্পনাতেই থেকে গিয়েছে। কিন্তু জাদুকরদের জাদুবিদ্যা শেখার সময় এই শক্তিমাত্রা বুঝতে শিখতে হয়। আদনান সেরকমই অস্বাভাবিক কোন শক্তির উপস্থিতি আশা করছিল। কিন্তু তেমন কিছু টের পেল না। এখানে যদি কোন অশরীরী থাকত, তাহলে ওর বুঝতে সময় লাগত না।
‘আমাকে তাড়াতে এসেছিস, জাদুকর?’ একটা ফ্যাঁসফ্যাঁসে পুরুষালি কন্ঠ বলে উঠল। সাথে সাথে রাকিবের বিকট হাসিতে পুরো রুমটা কেঁপে উঠল।
জাদুকর বলে সম্বোধন করায় একটু চমকে উঠল আদনান। রাকিবের তো সেটা জানার কথা না!
‘কে তুই?’
‘তুই তো নিজেকে খুব বাহাদুর ভাবিস। খুঁজে বের কর দেখি আমি কে।’
মনে মনে বিরক্ত হলো আদনান। এখানে কোন লুকোচুরি খেলতে আসেনি ও।
‘এই ছেলের উপর কোন কেন ভর করেছিস?’
‘আমি তো ভর করিনি। তুই কি টের পাচ্ছিস না?’
সত্যিই তো, আদনান ভাবল। এখানে তো কোন অশরীরী নেই। তাহলে রাকিবের এই দশা হলো কী করে?
‘সময় থাকতে চলে যা। এর পরিণতি কিন্তু ভাল হবে না।’ আদনান সাবধান করে দিল।
‘এত বড় সাহস তোর?’ রাকিব গর্জে উঠল। ‘আমাকে হুমকি দিস? আমার সাথে লাগতে আসিস না, জাদুকর। তোর মত জাদুকরদের মুরোদ আমার জানা আছে।’
‘ঠিক আছে। নিজের ধ্বংস ডেকে আনার জন্য তুই পরে আফসোস করবি।’ রুম থেকে বের হয়ে গেল আদনান।
৩.
রহমান সাহেব আর তার স্ত্রী দুইজনেই ড্রয়িং রুমে বসে আছেন। আদনান সেখানে চলে এল। এখন সেখানে আরও তিনজন যোগ হয়েছে। দারোয়ান আর কাজের বুয়া একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। সোফায় বসে আছে ওর বয়সী যুবক, রাকিবের চেয়ে তার বয়স কয়েক বছর বেশি হবে। আদনানকে দেখে সবাই উঠে দাঁড়াল।
‘কী বুঝলেন? কী হয়েছে রাকিবের?’ রাকিবের মা রেহানা বেগম শশব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘রাকিবের উপর কোন কিছু ভর করেনি।’ আদনান নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে বলল। ‘ওর উপর কেউ একজন দূর থেকে জাদু প্রয়োগ করছে।’
কথাটা শুনে সবার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কাজের বুয়াটা বিড়বিড় করে কিছু বলতে লাগল।
‘সেটা কিভাবে সম্ভব?’
‘যদি কেউ রাকিবের ক্ষতি করতে চায় আর রাকিবের ব্যবহার্য কোন জিনিসপত্র কোন জাদুকরকে দিতে পারে, তাহলে সম্ভব।’
‘ওই ভুডুর মত?’
‘এটা একটা ভুল ধারণা। ভুডু কোন জাদু না, এটা এক ধরণের ধর্মীয় বিশ্বাস। তবে আপনারা ভুডু বলতে যা বুঝিয়ে থাকেন, রাকিবের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে।’
‘কিন্তু এমনটা করবে কে? কার কী লাভ?’
‘সেটাই আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। তবে আমি নিশ্চিত কাজটা ভেতরের কেউই করেছে।’ আদনান রুমের সবার উপর নজর বুলালো। যুবকের উপর এসে ওর দৃষ্টি থেমে গেল।
‘আপনি কি ওকে জাদুমুক্ত করতে পারবেন না?’ মিরাজ রহমান জানতে চাইলেন।
‘পারব। কিন্তু সেক্ষেত্রে কিছুটা ঝুঁকি থেকে যায়। রাকিবের কোন ক্ষতি করে বসতে পারে জাদুকরটা। আমাকে আগে এই জাদুর পিছনে কে কলকাঠি নাড়ছে তাকে খুঁজে বের করতে হবে।’
‘আমার ছেলেকে সুস্থ করে দিন।’ রেহানা রহমান কাঁদতে শুরু করলেন। ‘আপনার যা লাগে আমরা দেব।’
‘বেশি কিছু লাগবে না, আমার ফি পরিশোধ করলেই চলবে।’ মুচকি হেসে বলল আদনান।
৪.
হাঁটতে হাঁটতে গেটের কাছে চলে এল আদনান। ওর কিছু তথ্য দরকার। এজন্য দারোয়ান আর কাজের লোকদের বিকল্প নেই।
‘আপনি কত দিন ধরে এখানে কাজ করছেন, চাচা?’ আদনান বৃদ্ধ দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল।
‘সোহাগের বাবা যখন এই বাড়িটা বানান, তহন থেইকেই এখানে আছি। উনি আমাদের গেরামের লোক ছিলেন। আমারে বেকার দেইখা উনি এখানে নিয়ে আসেন।’
‘তাহলে তো অনেক দিন ধরে আপনি এই পরিবারের সাথে আছেন।’
‘হ্যাঁ, মেলা দিন হইয়া গেছে। সোহাগ-মিরাজ তো আমার হাতের উপর দিয়াই বড় হইল। সোহাগের বিইয়া হয়ে গেছে। কয়দিন পর মিরাজেরও হইবো। আল্লাহ জানে ততদিন বাঁচমু কিনা।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বৃদ্ধ।
‘আপনার বড় সাহেব কেমন মানুষ?’
‘বড় সাহেবের মত ভালা লোক আর হয় না। আমারে খুব সম্মান দেন।’
‘উনি কি সবসময় এখানেই থেকেছেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। জন্মের পর থেকে তো এই বাড়িতেই আছেন।’
‘আচ্ছা চাচা, ইদানিং কি এখানে কোন ঝামেলা হয়েছে?’
দারোয়ান একটু ইতস্তত করলেন। বিষয়টা আদনানের চোখ এড়াল না। বৃদ্ধ কিছু একটা বলতে দ্বিধা করছেন, পরিবারের কথা বাইরের কাউকে বলতে ভরসা পাচ্ছেন না।
‘দেখুন, চাচা, আমি আপনাদের সাহায্য করতে এসেছি। এখানে আমার কোনো স্বার্থ নেই। আপনি কি চান না, রাকিব সুস্থ হয়ে উঠুক?’
“হ, তা তো চাই।’
‘তাহলে আমার কাছে কিছু লুকাবেন না। সত্যটা জানা খুব প্রয়োজন।’
‘ইয়ে… তেমন কিছু না।’ দ্বিধা কাটিয়ে বলতে লাগল বৃদ্ধ দারোয়ান। ‘দুই-তিন সপ্তাহ আগে বড় সাহেবের সাথে ছোট সাহেবের একটু কথা কাটাকাটি হইছিল। ছোট সাহেব কোন কাম কাজবার না কইরা হাওয়া খাইয়া বেড়ান। এজন্য বড় সাহেব বলেছিলেন ছোট সাহেবরে আর কোন টেকা-পয়সা দিবেন না। এরপর ছোট সাহেব উনার বাপের সম্পত্তির ভাগ খুঁজেন। এ নিয়ে একটু ঝগড়া হইছিল।’
আচ্ছা, তাহলে এই ব্যাপার!ভাবল আদনান। সম্পত্তির লোভে কি মিরাজ রাকিবের উপর জাদু প্রয়োগ করেছে? সে কি রাকিবকে মেরে ফেলে প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে? আজকাল তো এরকম অহরহ ঘটে থাকে।
কিন্তু মিরাজকে দেখে আদনানের মনে হয়নি সে জাদু জানে। সে জাদুকর হলে আদনান টের পেয়ে যেত। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ওকে সাবধান করে দিত। এর অর্থ একটাই, মিরাজ রাকিবকে অসুস্থ করতে অন্য কারও সাহায্য নিয়েছে। কিন্তু মিরাজের বিরুদ্ধে ওর কাছে প্রমাণ নেই। রাকিবের ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আগেই আদনানকে প্রমাণ জোগাড় করতে হবে। এজন্য সবকিছুর মূল হোতাকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু কে সে?
‘আচ্ছা চাচা, আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায় বললেন যেন?’
গ্রামের নামটা জেনে নিয়ে দারোয়ানকে ধন্যবাদ দিয়ে আদনান ড্রয়িং রুমে ফেরত এল। কিন্তু সেখানে এখন কেউ নেই। কাজের বুয়াটাকে দেখতে পেয়ে রহমান সাহেবকে খবর দিতে বলল ও।
ও যে সোফাটায় বসেছে, তারপাশেই একটা শো পিস স্ট্যান্ড। সেখানে একটা পেটমোটা অ্যালবাম দাঁড় করিয়ে রাখা আছে। আদনান বসে বসে ছবিগুলো দেখতে লাগল। আচমকা ওর মনে হলো ছবিগুলোর মধ্যে কোন একটা গোলমাল আছে। ও খুঁতটা বের করার আগেই সোহাগ রহমান উপস্থিত হলেন। আদনান অ্যালবামটা আগের জায়গায় রেখে দিল।
‘আমি আজকে চলে যাচ্ছি।’ ও বলল। ‘কালকে আবার আসব। আশা করি কালকেই রাকিব সুস্থ
হয়ে যাবে।’
সোহা রহমান হা করে আদনানের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কিছুটা বিস্মিত তিনি।
৫.
সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। পুরো দিনটা আদনানের খুব ব্যস্ত কেটেছে। ও হাতে জাদুর দন্ড আর কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে সোহাগ রহমানের বাড়িতে এসে ঢুকল। বাড়ির সবাই নিচতলার ড্রয়িং রুমে বসে আছে। আদনানের জন্য অপেক্ষা করছিল হয়ত।
‘আমাকে এখনই কাজে লেগে যেতে হবে।’ আদনান ব্যস্ত হয়ে বলল। ‘আমি রাকিবের রুমে যাচ্ছি।’
‘আমি আপনার সাথে গেলে কি সমস্যা হবে?’ মিরাজ বলে উঠল।
আদনানের ভ্রু কুঁচকে গেল। কিন্তু কথা বাড়ানোর সময় নেই। ‘আসুন।’
মিরাজকে নিয়ে দোতলায় চলে এল আদনান।
‘শুনুন,’ রাকিবের রুমে ঢোকার আগে মিরাজকে বলল ও। ‘ভেতরে কী হতে যাচ্ছে আমি ঠিক জানি না। কিন্তু যাই হোক না কেন, ভয় পাবেন না। ভয় অন্ধকারের সত্ত্বাকে আরও শক্তিশালী করে তুলে।’
মিরাজ মাথা ঝাঁকাল। কিন্তু আদনানের মনে হলো ও মিরাজের চোখে ভয় দেখতে পেয়েছে। আর কিছু না বলে রাকিবের রুমে ঢুকে গেল ও। ওর পিছনে মিরাজ ঢোকার পর ও ভাল করে দরজা বন্ধ করে দিল। এখন দরজা পার হয়ে কোন কিছু বাড়ির ভেতরে না ঢুকলেই হলো।
রাকিব মাথা নিচু করে ছিল। আদনান ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে ও ঝট করে মাথা তুলল। আদনান রাকিবের দিকে তাকিয়ে একটু থমকে গেল। পাশ থেকে একটা চাপা গোঙানির শব্দ ওর কানে এল।
হঠাৎ করেই রাকিবের অবস্থার অবনতি ঘটেছে। গতকালকের চেয়েও ভেঙ্গে পড়েছে ওর শরীর। রাকিবের চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে আদনান মিরাজের গুঙিয়ে উঠার কারণ বুঝতে পারল। রাকিবের চোখের কোটরে কোন চোখ নেই এখন। সেখানে এখন ঘন কালো অন্ধকার।
‘আমি তোকে শেষবারের মত বলছি, তুই ছেলেটাকে ছেড়ে চলে যা,’ গম্ভীর কন্ঠে আদেশ দিল আদনান।
‘তুই আবার এসেছিস, জাদুকর? তুই আমাকে হুমকি দিচ্ছিস? তান্ত্রিক সালেবানকে হুমকি দিচ্ছিস? নিজের প্রাণ থাকতে এখান থেকে পালা!’
কোনো কথা না বলে ব্যাগের ভেতর থেকে একটা বোতল বের করল আদনান। এরপর পবিত্র পানি ছিটিয়ে দিল রাকিবের উপর। চিৎকার করে উঠল রাকিব, ওর কন্ঠ দিয়ে তান্ত্রিকের আর্তনাদ শোনা গেল। রাকিবের পুরো শরীর খাটের উপর মোচড়াতে শুরু করেছে। আচমকা এক ঝাঁকুনির সাথে ওর হাতেপায়ে বাঁধা শেকলগুলো ছিঁড়ে গেল। সটাং করে রাকিব খাটের উপর দাঁড়িয়ে গেল। আদনান টের পেল মিরাজ পিছিয়ে গিয়েছে।
নিজেকে জাগিয়ে তুলল আদনান। ওর ভেতরের শক্তি এনে জমা করল হাতে। কানের পাশটা শিরশির করছে। রাকিবের দিকে জাদুর দন্ড তাক করল ও। মূহুর্তেই জাদুর দণ্ডের মাথায় একটা আলোক বিন্দু হাজির হলো। বিদ্যুৎ চমকাল যেন রুমের ভেতর। এক ঝাঁক সবুজ আলো আদনানের হাতে ধরা দন্ড থেকে বের হয়ে রাকিবের শরীরে গিয়ে আঘাত করল। তীব্র আলোর চোটে চোখ বন্ধ করে ফেলল মিরাজ।
রুমের লাইট ততক্ষণে নিভে গিয়েছে। কিন্তু বিন্দু বিন্দু সবুজ আলো রুম জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আদনান মিরাজকে মেঝেতে লুটিয়ে পড়তে দেখল। মনে মনে হাসল ও। জাদু দেখতে এসে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে ছেলেটা, জাদুর ধাক্কা সহ্য করতে পারেনি।
আদনানের মৃদু কন্ঠ শোনা গেল অন্ধকারে। সাথে সাথে ওর জাদুর দন্ড থেকে একটা আলোর গোলক বের হয়ে উপরে উঠে
গেল। চারপাশ দিনের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। সেই আলোয় আদনান দেখতে পেল একটু আগে ওর প্রয়োগ করা জাদু কাজে দিয়েছে।
রাকিব খাটে পড়ে আছে। ওর পাশে কিছু ধোঁয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। আস্তে আস্তে সেগুলো ঘন হচ্ছে, একটা মানুষের অবয়বে রুপ নিচ্ছে। কিন্তু সেটা পুরোপুরি মানুষে পরিণত হল না, একটা ছায়ার মত থেকে গেল।
আদনান কিছু বুঝে উঠার আগেই এক ঝলক কমলা রঙের আলো এসে ওর গায়ে আঘাত করল। দেয়ালের উপর ছিটকে পড়ল ও, তীব্র ব্যথায় ককিয়ে উঠল। মেরুদন্ড ভেঙ্গেই গিয়েছে বলে মনে হলো ওর। এরকমটা আশা করেনি ও। একটা ছায়া ব্যবহার করে তান্ত্রিকটা এত জোরালো জাদু প্রয়োগ করতে পারবে সেটা ভাবতেই পারেনি।
কোনমতে উঠে দাঁড়াল আদনান। চকিতেই ও দেখতে পেল সাদা রঙের কিছু ওর দিকে ধেয়ে আসছে। আদনান ওর দুই হাত সামনে এনে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
বস্তুটা আদনানের সামনে এসে যেন অদৃশ্য কোন দেয়ালে গোত্তা খেল। এরপর আবার উল্টো দিকে ছুটতে লাগল। ছায়াটার গায়ে গিয়ে আঘাত করতেই একটা আর্তনাদ শুনতে পেল আদনান। অনেক দূর থেকে শব্দটা ভেসে আসছে।
দেরি করল না ও। নিজের পুরো মনযোগ কেন্দ্রীভূত করে অবয়বটার দিকে মননিবেশ করল। ওর পুরো শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। জাদুর দন্ডটা ও ছায়ার দিকে তাক করল। সাথে সাথে উজ্জ্বল কমলা আর নীল রঙের শিখা অবয়বটার দিকে ছুটে গেল। মুহুর্তেই আগুন ধরে গেল অবয়বটার গায়ে। রুমের মধ্যে যেন ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গেল। অবয়বটা লাফাতে লাগল, জান্তব চিৎকারে কান ফাটার উপক্রম হল আদনানের। আদনান ওর শেষ জাদুটা ছুড়ে দিল।
একটা সাদা আলো গিয়ে অবয়বটাকে ঘিরে ধরল। সাথে সাথে অবয়বটার নড়নচড়ন বন্ধ হয়ে গেল। কেউ যেন সেটাকে জায়গাটাতে আটকে দিয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে অবয়বটা চিৎকার করছে। কানফাটা পুরো বাড়িটা কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল, যেন এখনই ধ্বসে পড়বে।
‘তুই ধ্বংস হয়ে যাবি, জাদুকর!’ কন্ঠটা যেন অনেক গভীর কূপ থেকে ভেসে আসছে, যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। ‘তুই জানিস না তুই কী করেছিস। এবারের মত আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি ফিরে আসব। তিলে তিলে তোকে শেষ করব তখন। মৃত্যু ভিক্ষা করবি তুই আমার কাছে। তোর আত্মা আমি তোর থেকে কেড়ে নেব।’
এসব হুমকি পাত্তা দিল না আদনান। কিন্তু ওর বুকটা কেঁপে উঠল। আস্তে আস্তে চিৎকারটা কমে যাচ্ছে। অবয়বটা শেষমেশ ধোঁয়া হয়ে জানালা দিয়ে উধাও হয়ে গেল। সাথে সাথে রুমের লাইটগুলো জ্বলে উঠল। আচমকা রাজ্যের সব ক্লান্তি এসে ভর করল আদনানের উপর। ওর শরীরের সব শক্তি যেন নিংড়ে নেয়া হয়েছে। ওর শুয়ে যেতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু আরও কিছু কাজ বাকি আছে।
৬.
পরের দিন সকাল এগারোটার দিকে সোহাগ রহমানের বাসায় চলে এল আদনান। আগেই জানিয়ে রেখেছে ও সকালে আসবে। ড্রয়িং রুমে সবাই ওর জন্য অপেক্ষা করছিল।
‘রাকিব কেমন আছে?’ মি.রহমানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল আদনান।
‘ডাক্তার বলেছে ও রক্তশূন্যতায় ভুগছে, দুর্বল হয়ে পড়েছে। সুস্থ হতে কিছুটা সময় নেবে।’
আদনান মাথা দোলাল। এরপর ও লেকচার দেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেল। মি. আর মিসেস রহমান এবং মিরাজ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কাজের বুয়া আর দারোয়ান নেই আজকে। ওদের ডাকার প্রয়োজন মনে করেনি আদনান।
‘রাকিবের আশা করি আর কোন সমস্যা হবে না। ওর উপর থেকে জাদুর প্রভাব কেটে গিয়েছে।’
মিসেস রহমান স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন। আদনান মনে মনে হাসল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ভদ্রমহিলার স্বস্তি একেবারেই গায়েব হয়ে যাবে।
‘তবে ওর উপর থেকে বিপদ কেটে যায়নি!’ নাটুকে গলায় বলল ও। শ্রোতাদের মুখের হতভম্ব ভাবটা ও বেশ উপভোগ করছে।
‘রাকিবের উপর যে তান্ত্রিক জাদু খাটিয়েছিল সে হয়ত চলে গিয়েছে। কিন্তু শুরুতেই আমি আপনাদের বলেছিলাম এর পিছনে অন্য কেউ আছে। আমি এখন জানি কে সেই ব্যক্তি।’
‘কে করেছে এই কাজ?’ বলে উঠল রাকিবের মা।
‘শুরু থেকেই ধারণা করছিলাম, রাকিবের ঘনিষ্ঠ কেউ এর জন্য দায়ি। প্রথমে আমি মিরাজ রহমানকে সন্দেহ করেছিলাম। দিন কয়েক আগে উনার মি.সোহাগ রহমানের সাথে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা হওয়ার কথা জানতে পেরেছি আমি। ভেবেছিলাম রাকিবের উপর জাদু প্রয়োগ করে উনি ভাইয়ের উপর প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছেন।’
মিরাজকে বিচলিত দেখাল, নড়েচড়ে বসল ও।
‘কিন্তু আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সেটা মেনে নিতে পারছিল না। এজন্য আমি আরেকটু গভীরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তখন আরেকজন আমার সন্দেহের তালিকায় যুক্ত হয়। আজ সকালেই আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি আসল অপরাধী কে।’
আদনান সবার মুখের দিকে তাকাল, অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করেছে।
‘কে সেই অপরাধী?’ সোহাগ রহমান গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন।
আদনান মুচকি হাসল। ‘আপনি।’
৭.
ঝট করে দাঁড়িয়ে গেলেন সোহাগ রহমান।
‘কী বলতে চাচ্ছেন আপনি? আমার বাড়িতে এসে আমাকেই অপমান করছেন?’
‘আমি কাউকে অপমান করছি না, সত্যটা বললাম মাত্র।’ আদনান জবাব দিল।
‘আমার ছেলের উপর আমি কেন জাদু প্রয়োগ করব?’
‘কারণ রাকিব আপনার ছেলে না।’
সোহাগ রহমানের মুখে কেউ যেন জুতোপেটা করেছে। উনার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না। ধপ করে উনি সোফায় বসে পড়লেন। রেহানা রহমান আর মিরাজের চোখ বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গিয়েছে। এই গোপন কথাটা তারা আদনানের মুখ থেকে আশা করেনি।
‘আমি আপনাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকেই আমি জানতে পারি সোহাগ
রহমানের এক বিধবার সাথে বিয়ে হয়। সেই বিধবার এক সন্তানও ছিল। পিতার জোরাজুরিতে সোহাগ রহমান সন্তানটিকে নিজের সন্তান হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু মন থেকে উনি কখনও রাকিবকে নিজের সন্তান বলে মেনে
নিতে পারেননি। এদিকে ধীরে ধীরে রাকিব উনার চক্ষুশূল হয়ে উঠে। নিজের একটা সন্তান থাকলে সোহাগ রহমান হয়ত এই পথে পা বাড়াতেন না। কিন্তু আমার ধারণা উনি সন্তান উৎপাদনে অক্ষম।’
আদনান খেয়াল করল মি.রহমান মাথা নিচু করে রেখেছে, ওর কথার কোন প্রতিবাদ করেননি। নিজের ধারণাটাকে সত্য বলে মেনে নিল ও।
‘আমার মনে হয় না সোহাগ রহমান এই প্রথম রাকিবকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমি নিশ্চিত অতীতে উনি এরকম আরও চেষ্টা চালিয়েছেন। মিসেস রহমান আশা করি মনে করতে পারবেন।’
মিসেস রহমান স্বামীর দিকে তাকালেন। উনার দৃষ্টিতে ঘৃণার ছাপ স্পষ্ট, সেই সাথে চোখ বেয়ে নামছে অশ্রু।
‘তবে এই প্রথম উনি রাকিবকে হত্যা করতে জাদুর সাহায্য নেন। তান্ত্রিকের সাথে উনার কিভাবে পরিচয় হয়েছে সেটা উনিই ভাল বলতে পারবেন। আজ সকালে আমি থানায় গতকাল রাতে কোন অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে কিনা খোঁজ
নিয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, তান্ত্রিক আপনাদের বাসার আশেপাশেই আছে। কারণ খুব বেশি দূর থেকে জাদু প্রয়োগ করা সম্ভব না, সে যতই শক্তিশালী জাদুকর হোক না কেন। পুলিস জানিয়েছে একটা পুরুষের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে, মৃত্যুর কারণ অজ্ঞাত। যে বাড়িতে লাশটা পাওয়া যায়, সেখানের গেটের দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি মৃত লোকটার পরিচয় কেউ জানে না। সে সপ্তাহে একবার শুধু ঘর থেকে বের হত, তার সাথে কেউ দেখা করতেও আসত না। শুধু কয়েক দিন আগে নাকি এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছিলেন। ভদ্রলোকের শারীরিক বর্ণনা শুনে আমার বুঝতে বাকি থাকল না যে সেই ভদ্রলোক আর কেউ নন, সোহাগ রহমান।’
মিসেস রহমান ফুঁপিয়ে উঠলেন। সোহাগ রহমান এখনও নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। উনার ভাবভঙ্গি বোঝার উপায় নেই। মিরাজের চোখ যেন কোটর থেকে বের হয়ে আসবে।
আদনান বিষয়টাতে আর নাক গলানোর প্রয়োজন মনে করল না। ওর কাজ শেষ, বাকিটা সোহাগ রহমানের পারিবারিক ব্যাপার।
‘আমার ফি দয়া করে পাঠিয়ে দেবেন। আমার কাজ শেষ, আমি এবার আসি।’
আদনান বাসাটা থেকে বের হয়ে এল। ওর বাইকটা মসৃণ রাস্তা ধরে ছুটে যাচ্ছে। আচমকে তান্ত্রিকের হুমকি মনে পড়ে গেল ওর। অনেক আগেই ভয় ওর মন থেকে মুছে গিয়েছে। তবুও এই দিনের আলোতেও ওর গা শিরশির করে উঠল।
সত্যিই তান্ত্রিক ফিরে আসবে? প্রতিশোধ নিতে?SayeedShihab2739-1457838887-3600816_xlarge

মন্তব্য করুন

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।